প্রস্তাবিত বাজেটে মধ্যবিত্তদের স্বস্তি দিয়ে উচ্চবিত্তদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বাজেটে গৃহীত পদক্ষেপের মাধ্যমে মধ্যবিত্তদের ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ছাড় দেয়া হয়েছে। ঠিক উল্টো চিত্র উচ্চবিত্তের বেলায়। এই শ্রেণির নাগরিকরা শুধু সর্বোচ্চ করহারে ছাড় পেয়েছেন। বাজেট বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এবারের বাজেটে শুরুতেই মধ্যবিত্তদের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে স্বস্তি দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ ৫ বছর পর ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে।
একইভাবে আনুপাতিক হারে মহিলা, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ও গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত সীমা বাড়ানো হয়েছে। এতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে মধ্যবিত্ত। এ ছাড়া করহারও কমানো হয়েছে।
আগে যেখানে সাড়ে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের জন্য ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো, এখন সেখানে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত ১০ শতাংশ কর নির্ধারণ করা হয়েছে। উপরন্তু ৩ লাখ টাকা পরবর্তী ১ লাখ টাকার জন্য ৫ শতাংশ হারে করারোপ করে নতুন একটি স্ল্যাব করা হবে। অর্থাৎ, ৪ লাখ টাকা আয় হলে ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
অন্যদিকে বাজেটে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক খাতে করহারে পরিবর্তন আনা হয়নি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে নিত্যপণ্যের দাম কমানো হয়েছে। যেমন : চাল, আটা, আলু, পেঁয়াজ-রসুন স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর আদায় করা হতো। এটি কমিয়ে ভিত্তিমূল্যের ২ শতাংশ করা হয়েছে। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দাম কমতে পারে।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সরিষার তেলের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তাই পণ্যটির দাম কমতে পারে। আলুর পটেটো ফ্লেক্স তৈরির ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে চিপসের দাম কমতে পারে। পোলট্রি শিল্পের বিকাশে অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। এতে ব্রয়লার মুরগির দাম কমতে পারে। হাঁস-মুরগির খাদ্য উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ ছিল। এটি কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। এর প্রভাবে বাজারে হাঁস-মুরগির দাম কমতে পারে। এসব কারণেও খুশি মধ্যবিত্ত।
বিদ্যমান করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সুরক্ষাসামগ্রীতে কর ছাড় দেয়া হয়েছে। দেশে উৎপাদিত পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এতে দাম কমতে পারে।
এ ছাড়া দেশে উৎপাদিত সার্জিক্যাল মাস্ক (ফেস মাস্কসহ) উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধের লক্ষ্যে কোভিড-১৯ টেস্ট কিটের আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এতে টেস্ট কিটের দাম কমতে পারে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে সম্মানিত করদাতাদের প্রকৃত আয় হ্রাস পাওয়ায় এবং অন্যদিকে করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত থাকায় সম্মানিত করদাতারা কর দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না।
এ বছর বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সম্মানিত করদাতারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
এসব বিবেচনায় নিয়ে এবং মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বৃদ্ধি এবং করহার হ্রাসের প্রস্তাব করছি।
এতে ব্যক্তি করদাতাদের করভার লাঘবের ফলে জীবনযাত্রায় কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসবে এবং করদাতারা নিয়মিতভাবে কর দিতে উৎসাহিত হবেন বলে আশা করছি।
অন্যদিকে উচ্চবিত্তরা ছাড় পেয়েছেন শুধু করহারে। এই শ্রেণির করদাতারা আগে ৩০ শতাংশ হারে কর দিত, আগামী বছর থেকে ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। এ ছাড়া বাজেটে সারচার্জ বা সম্পদ করে হাত দেননি অর্থমন্ত্রী। অর্থাৎ, আগের হারেই সারচার্জ দিতে হবে।
অবশ্য আগামী বছর থেকে উচ্চবিত্তদের ব্যক্তিগত গাড়ি নিবন্ধনে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হবে। প্রথমত, প্রস্তাবিত বাজেটে সিসিভেদে অগ্রিম কর বাড়ানো হয়েছে।
দ্বিতীয়ত; বিআরটিএ ফি’র সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। বাজেটে ১৫০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির রেজিস্ট্রেশনে অগ্রিম কর ১০ হাজার বাড়িয়ে ২৫ হাজার, ১৫০০ থেকে ২০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির কর ২০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা, ২০০০ থেকে ২৫০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির কর ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৭৫ হাজার টাকা, ২৫০০ থেকে ৩০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির কর ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ৩০০০ থেকে ৩৫০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির কর ৭৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৩৫০০ সিসির বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ির ক্ষেত্রে ২ লাখ টাকা এবং মাইক্রোবাসে ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম আয়কর ধার্য করা হচ্ছে।
অন্যদিকে উচ্চবিত্তের ব্যাংক হিসাবেও হাত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ব্যাংক হিসাবে বেশি টাকা থাকলে বেশি কর আদায়ের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
যেমন: বছরের যে কোনো সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা থাকলে ১৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক আদায় করা হবে।
আগে ১২ হাজার টাকা আদায় করা হতো। আর ৫ কোটির বেশি টাকা থাকলে ৪০ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক আদায় করা হবে। এতদিন ২৫ হাজার টাকা আদায় করা হতো। তবে মধ্যবিত্তের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে আগের নিয়মেই আবগারি শুল্ক আদায় করা হবে।