সৃষ্টিগতভাবে মানুষের ভেতর দুই ধরনের প্রবৃত্তি কাজ করে। ভালো প্রবৃত্তি; যা মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে। মন্দ প্রবৃত্তি; যা মানুষকে মন্দ কাজে উৎসাহিত করে। কু-প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ যেসব কাজ করে, তাকে ‘আখলাকে সায়্যিআহ’ বা মন্দ স্বভাব বলা হয়। যেমন মিথ্যা, মূর্খতা, অহংকার, কৃপণতা, পরনিন্দা, প্রতারণা ইত্যাদি। আখলাকে সায়্যিআহ মানুষের জাগতিক সাফল্য ও পরকালীন মুক্তির পথে অন্তরায়। ইসলাম এসব স্বভাব পরিহার করার নির্দেশ দিয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দুশ্চরিত্র ও রূঢ় স্বভাবের মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮০১)
কোরআন ও হাদিসে মানুষের সব ধরনের মন্দ স্বভাব পরিহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তেমন কয়েকটি মন্দ স্বভাব হলো
আল্লাহকে ভুলে থাকা
মানুষের একটি নিকৃষ্টতম স্বভাব হলো তার স্রষ্টার স্মরণ থেকে বিমুখ থাকা। কেননা, তা মানবহৃদয়কে মৃতে পরিণত করে। বিভিন্ন মন্দ স্বভাবকে উৎসাহিত করে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে আল্লাহর স্মরণ করে এবং যে আল্লাহকে স্মরণ করে না; তাদের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও মৃতের মতো।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ৬৪০৭)
গরিমা ও অহংকার
অহংকার বা আত্মম্ভরিতা আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম স্বভাব। আল্লাহ অহংকার অপছন্দ করেন এবং তা মানুষের পতন ডেকে আনে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ কোনো উদ্ধত-অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৮)
পরকালেও অহংকারী ব্যক্তির পরিণতি হবে ভয়াবহ। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যার অন্তরে এক অণু পরিমাণও অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯১)
অসত্য বলা বা মিথ্যাচার
মিথ্যাচার জঘন্যতম পাপ। কথাবার্তা, কাজকর্ম ও আইন-আদালত সর্বত্র মিথ্যা পরিহার করে চলতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মিথ্যাকে শিরকের পরে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং তোমরা বর্জন করো মূর্তিপূজার অপবিত্রতা এবং দূরে থাকো মিথ্যা কথন থেকে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩০)
হাদিসের বর্ণনা মতে, মিথ্যা সব পাপের মূল এবং তা মানুষকে জাহান্নামে পৌঁছে দেয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই মিথ্যা পাপাচার পর্যন্ত পৌঁছে দেয় এবং পাপাচার জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। ব্যক্তি যখন অনবরত মিথ্যা বলতে থাকে, তখন আল্লাহর কাছে তাকে মিথ্যাবাদীরূপে লিপিবদ্ধ করা হয়।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ৬০৯৪)
সম্মান ও সম্পদের মোহ
সম্মান ও সম্পদের মোহ বহু পাপের কারণ, যা মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ছাগলের পালে দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘ ছেড়ে দিলে যেমন ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, সম্মানের লিপ্সা ও সম্পদের মোহ মানুষের দীনের জন্য তার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৭৬)
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যার দ্বারা আল্লাহ তোমাদের কাউকে অপর কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তোমরা তার লালসা করো না।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৩২)
দুনিয়ার মোহ ও লালসা
পার্থিব জীবন ও জীবনোপকরণের চাহিদা মানুষকে পাপকাজের প্রতি ধাবিত করে। মানুষকে আল্লাহর স্মরণ ও পরকালীন চিন্তা থেকে বিমুখ করে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়া ভালোবাসল, সে তার পরকালকে ক্ষতিগ্রস্ত করল। আর যে ব্যক্তি আখিরাতকে ভালোবাসল, সে তার দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করল। সুতরাং তোমরা অস্থায়ী বস্তুর ওপর স্থায়ী বস্তুকে প্রাধান্য দেবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৪/৪১২)
কৃপণতা
খিয়ানত, বিশ্বাসঘাতকতা ও নির্দয়তার মতো মন্দ স্বভাবের সৃষ্টি হয় কৃপণতা থেকে। এর কারণে মানুষের সামাজিক সম্মানও ক্ষুণœ হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তাদের দিয়েছেন, তাতে যারা কৃপণতা করে তাদের জন্য তা মঙ্গল এটা যেন তারা কিছুতেই মনে না করে। বরং এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে বিষয়ে তারা কৃপণতা করবে, কিয়ামতের দিন তাদের গলায় তার বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হবে।’ (সুরা আল-ইমরান, আয়াত : ১৮০)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে এবং মানুষের থেকে দূরে থাকে। কিন্তু জাহান্নামের নিকটবর্তী থাকবে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৯৬১)
অপব্যয় ও অপচয়
ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃপণতা যেমন দূষণীয়, অনুরূপ অপব্যয় এবং অপচয় দূষণীয়। শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ কাজেও অপচয় ও অপব্যয় নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা খাও এবং পান করো; কিন্তু অপব্যয় করবে না। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অপব্যয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৩১)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৬-২৭)
ক্রোধ ও রাগ
অনিয়ন্ত্রিত রাগ মানুষের হিতাহিত জ্ঞান কেড়ে নেয়। অন্যায় ও অবৈধ কাজে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিকে লজ্জিত হতে হয়। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তারা ক্রোধান্বিত হয়, তখন তারা ক্ষমা করে দেয়।’ (সুরা আশ-শুরা, আয়াত : ৩৭)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘ওই ব্যক্তি বীরপুরুষ নয়, যে অন্যকে ধরাশায়ী করে। বরং সেই প্রকৃত বীর, যে রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ৬১১৪)
হিংসা-বিদ্বেষ
ইসলামের দৃষ্টিতে হিংসা একটি মানসিক ব্যাধি, যা মানুষের মানসিক স্বস্তি ও শান্তি নষ্ট করে। সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্টের কারণ হয়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বিরত থাকো। কেননা, হিংসা নেক আমলকে নষ্ট করে দেয়। যেভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৭৩)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ হিংসা থেকে পানাহ চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই, যখন সে হিংসা করে।’ (সুরা ফালাক, আয়াত : ৫)
আত্মগৌরব ও আত্মপ্রশংসা
আত্মপ্রশংসা ও আত্মগৌরব মানুষকে বাস্তবতাবিমুখ করে। ইসলাম আত্মগৌরব থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না, কে আল্লাহভীরু এ সম্পর্কে তিনিই সম্যক অবগত।’ (সুরা নাজম, আয়াত : ৩২)
মহানবী (সা.) বলেন, ‘প্রবৃত্তির অনুগামী হওয়া, কৃপণতার অনুগত হওয়া এবং আত্মপ্রশংসায় লিপ্ত হওয়া এগুলো হচ্ছে ধ্বংসাত্মক বদ-অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত। তবে এসবের মধ্যে শেষোক্তটি হচ্ছে সবচেয়ে জঘন্য।’ (সুনানে বায়হাকি)
গালাগাল
গালি দেওয়া ও অশ্লীল ও অকথ্য ভাষা ব্যবহার করা ইসলামের দৃষ্টিতে নিন্দনীয়। শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি বড় ধরনের পাপ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুমিনের সঙ্গে লড়াই করা কুফরি এবং তাকে গালি দেওয়া ফিসক (প্রকাশ্য পাপ)।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৪১১৩)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রকৃত ইমানদার ব্যক্তি কারও প্রতি ভর্ৎসনা ও অভিশাপ করে না এবং সে কোনো অশালীন ও অশ্লীল কথাও বলে না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৯৭৭)
ধোঁকা ও প্রতারণা
ধোঁকা ও প্রতারণা কোনো মুমিনের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। মুমিন তার জীবনের কোনো কথা ও কাজে প্রতারণার আশ্রয় নেবে না। বাহ্যত নিজের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকলেও সে সত্য বলবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মত হিসেবে গণ্য হবে না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৩১৫)