অনলাইন ডেস্ক:
বরিশালের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ফসল ‘বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম’। শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্ত্বরে যার নির্মান কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ১৩ই জানুয়ারী। এমনকি গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারী নির্মানাধিন ৫শ আসন বিশিষ্ট ৫তলা ভবনের এই অডিটরিয়ামটির উদ্বোধনও করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ পেরিয়ে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো সম্পন্ন হয়নি বহুল প্রতিক্ষিত এই অডিটরিয়াম নির্মান কাজ। বরং কাগজে কলমে কাজ সমাপ্ত দেখিয়ে বরাদ্দের ২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও বিশেষ বরাদ্দে নির্মানাধিন এই বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ খোদ বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও জেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি আহাসান হাবিব কামালের বিরুদ্ধে। দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন সাবেক মেয়রের ঘন্টিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ঠিকাদার সহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম।
অপরদিকে বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম নিয়ে পুকুর সমান দুর্নীতির বিষয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গন সহ বিভিন্ন মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিক অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু দিন পেরিয়ে সপ্তাহ ও মাস পেরিয়ে বছর গেলেও অভিযোগ তদন্ত বা ব্যবস্থা গ্রহনে অগ্রগতী আসেনি দুদকের। তবে বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম নিয়ে দুর্নীতি এবং অভিযোগ তদন্তের পাশাপাশি দ্রুত কাজ সম্পন্নের আশ্বাস দিয়েছেন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নতুন মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানাগেছে, সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও সুশীল সমাজের দীর্ঘ দিনের দাবীর প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আদেশে ১০ তলা ভিতে ৫শ আসন বিশিষ্ট ৫ তলা অডিটরিয়াম প্রকল্প গ্রহন করে সিটি কর্পোরেশন। এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয় ‘বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম’। সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ও সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের ঠিকাদারী পায় মেসার্স কহিনুর এন্টারপ্রাইজ ও মোমেন সিকদার (জেভি) নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ১৭ কোটি ২৭ লাখ ৩১ হাজার ৫৫০ টাকা চুক্তিতে ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারী শুরু হওয়া অডিটরিয়াম নির্মান কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০১৫ সালের ১২ই জানুয়ারীর মধ্যে।
কিন্তু রহস্যজনক কারনে নির্মানাধীন ভবনটির কাজ আদৌ শেষ হয়নি। বরং কাজ শুরুর বছর খানেকের মাথায় ঠিকাদার নিজেদের মত করে মিলন মন্ডল নামের একজন ডিজাইনারকে দিয়ে অডিটরিয়ামের নকশা পরিবর্তন করিয়ে কাজের সময় ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাড়িয়ে নেয়। সেই সাথে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ২৫ কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু বর্ধিত সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ করেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়ামের ঠিকাদার মোমেন সিকদার বিসিসি’র সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামাল এর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। সেই সুবাধে কাজের শুরুতেই অনিয়ম এবং দুর্নীতিতে মেতে ওঠেন। এর প্রতিবাদ করায় বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম প্রকল্পের প্রথম প্রজেক্ট ডায়রেক্টর (পিডি) নির্বাহী প্রকৌশলী আনিচুজ্জামানকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। পরিবর্তে বিসিসি’র সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোতালেব হোসেন এবং পরবর্তীতে প্রধান প্রকৌশলী খান মো. নুরুল ইসলামকে পিডি’র দায়িত্ব দেয়া হয়।
সূত্রটি আরো জানায়, প্রকল্পের ঠিকাদার মোমেন সিকদার যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা। তাছাড়া সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন ঠিকাদার মোমেন সিকদার। যে কারনে কাজ সম্পন্ন না হলেও কাগজে কলমে বিলের বৈধতা দেখিয়ে ২৫ কোটি টাকাই উত্তোলন করে নিয়ে ঠিকাদার।
সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র এর দায়িত্ব নেয়ার পরে তিনি নির্মানাধীন বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম পরিদর্শন করেছেন। তিনি ওই প্রজেক্টের ফাইল নিজ কাষ্টরিতে নিয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়ামের অসম্পন্ন কাজ খুব দ্রুত শেষ করার বিষয়ে আশ্বস্থ করেছেন। সেই সাথে দুর্নীতির বিষয়টিও তদন্তের উদ্যোগ নিবেন বলেও জানিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়ামের নির্মাণ কাজ তদারকি কমিটির সদস্য সচিব ও বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি কাজল ঘোষ বলেন, আমরা ততকালিন মেয়র আহসান হাবিব কামালের কাছে কয়েকবার গিয়েছি এবং অডিটোরিয়ামের বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। তার পরেও কোন কাজ হয়নি। পরে বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে নিয়ে নির্মানাধীন ভবন পরিদর্শ করেছি। তিনি অশ্বস্ত করেছেন যত দ্রুত সম্ভব ভবনের কাজ শেষ করার জন্য।
অডিটরিয়ামের কাজ শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সাংস্কৃতিক সংগঠন খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারের সভাপতি নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, বরিশালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ভালো কোনো অডিটরিয়াম নেই। বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম বরিশালের সাংস্কৃতিক কর্মীদের স্বপ্ন দেখিয়েছে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের এ প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে এমন উদাসীনতা দুঃখজনক।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ও বঙ্গবন্ধু অডিটোরিয়াম প্রকল্পের পিডি খান মো. নুরুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রনালয় থেকে অডিটরিয়ামের নকশায় কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু বরাদ্ধ না থাকায় কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছেনা। যতটুকু বরাদ্ধ হয়েছে সেই পরিমান কাজও হয়েছে বলেই ঠীকাদারকে বিল পরিশোধ করেছি। এ কাজে কোন অনিয়ম হয়নি বলে দাবী এই কর্মকর্তার।
সদ্য বদলী হওয়া দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত বরিশাল জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক এবিএম আবদুস সবুর বলেন, বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম নিয়ে আমরা অনেক অভিযোগ পেয়েছি। কিন্তু অনেকগুলো বিষয় হওয়ায় এখনো তদন্ত শুরু করা সম্ভব হয়নি। যদি একটি বিষয় হতো তাহলে অনেক আগেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া যেত।
তিনি বলেন, এটা শুধুমাত্র ঠিকাদারের বিষয় নয়। এর সাথে আরো অনেকেই জড়িত রয়েছে। যারা সিটি কর্পোরেশনের সাথে যুক্ত। অবশ্য তদন্ত শুরু না হলেও এরই মধ্যে আমি অনেক তথ্য প্রমান এবং কাগজপত্র সংগ্রহও করেছি। কিন্তু বদলী জনিত কারনে ফাইলটি চূড়ান্ত করতে পারলাম না। তবে নতুন যিনি আসছেন তাকে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য বলবেন বলে জানিয়েছেন দুদকের এই কর্মকর্তা।