বাঁশের বেড়া উপেক্ষা করে ভাষার দাবিতে আন্দোলনে শহীদদের সম্মিলিত শ্রদ্ধা জানাল ভারত-বাংলাদেশ। ভৌগলিক সীমারেখা ভুলে কেবলমাত্র ভাষার টানে দু‘বাংলার মানুষ একই মঞ্চে গাইলেন বাংলার জয়গান।
আমার প্রতিরোধ আমার সংগ্রাম আমার স্বাধীনতা আমার অধিকার আমার ৫২ আমার বর্ণমালা’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে এপার ওপার দুই বাংলার একুশ উদযাপন পরিষদের আয়োজনে মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যৌথভাবে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যে দিয়ে এবারও পালন করেছে এক সঙ্গে বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে।
বৃহস্পতিবার সকালে এভাবেই কাটালেন দুই বাংলার ‘বাংলা ভাষাভাষি’ মানুষ। সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে শহীদ বেদী ঢাকল ফুলের চাদরে।
বেনাপোল চেকপোস্ট নোম্যান্সল্যান্ডে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারও ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানো হলো। মিষ্টি বিতরণ, আলোচনা আর গানে গানে মাতোয়ারা হলো দুই বাংলার একই আকাশ একই বাতাস। উভয়দেশের জনপ্রতিনিধিরা বলেন, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কথা। এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার ভাষাপ্রেমি মানুষ।
নেতাদের কণ্ঠে ছিল ভবিষ্যতে আরও বড় করে এক মঞ্চে একুশসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান উদযাপনের প্রত্যাশা। উভয়দেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় এ অনুষ্ঠানে। দু’দেশের জাতীয় পতাকা, নানা রং এর ফেস্টুন, ব্যানার, প্লেকার্ড, আর ফুল দিয়ে বর্নিল সাজে সাজানো হয় নোম্যান্সল্যান্ড এলাকা। দু’বাংলার মানুষের এ মিলন মেলায় উভয়দেশের সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয়।
প্রতি বছরই দুই বাংলার সীমান্তবর্তী এ অংশের বাসিন্দারা এক সঙ্গে মিলিত হয়ে দিবসটি পালন করেন। তখন দুই দেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী ওই স্থানে আবেগাপ্লুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। একে অপরকে আলিঙ্গন করে সকল ভেদাভেদ যেন ভুলে যায় কিছু সময়ের জন্য। ফুলের মালা ও জাতীয় পতাকা বিনিময় করে উভয় দেশের আবেগপ্রবণ অনেক মানুষ বাঙালির নাড়ির টানে একজন অপরজনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। দুই বাংলার মানুষের মাঝে বসে এক মিলন মেলা। এ সময় পেট্রাপোল ও বেনাপোল চেকপোস্টে ঢল নামে হাজার হাজার মানুষের। ক্ষণিকের জন্য হলেও স্তব্ধ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক সীমারেখা।
বেলা ১১টায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী শ্রী জ্যোতি প্রিয় মল্লিক, বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস ও বনগাঁ পৌর মেয়র শংকর আঢ্যর’র নেতৃত্বে ভারত থেকে আসা শতশত বাংলাভাষি মানুষ বাংলাদেশিদের ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে ও মিষ্টি দিয়ে বরণ করে নেয় একে অপরকে।
নোমান্সল্যান্ডে অস্থায়ী শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ভারতের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, বঁনগা লোকসভার সাংসদ শ্রীমত্যা মমতা ঠাকুর, উত্তর ২৪ পরগণা জেলা পরিষদের সভাধিপতি শ্রীমতি বীনা মন্ডল, বিধানসভা বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস ও বনগাঁও পৌর সভার মেয়র শংকর আঢ্য।
বাংলাদেশের পক্ষে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্রাচার্য্য, যশোর-১ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব শেখ আফিল উদ্দিন, কাস্টমস কমিশনার বেলাল হোসেন চৌধুরী, ৪৯ বিজিবির ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর নজরুল ইসলাম, একুশ উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম মঞ্জু, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ নুরুজ্জামান।
ভাষা দিবসের মিলন মেলায় বিজিবি বিএসএফকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। এরপর দু’দেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে হাজার হাজার ভাষাপ্রেমী মানুষ দিবসটি উদযাপন করে যৌথভাবে।
বেনাপোল একুশ উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম মঞ্জুর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, আমি বাংলায় কথা বলি পুন:জন্মে আমি বাঙালি হয়ে জন্মাতে চাই। কাটাতারের বেড়া আমাদেরকে আটকাতে পারে কিন্ত আমাদের আবেগকে আটকাতে পারবে না। আমরা হয়তো থাকবো না। আগামীতে কোনো কাটাতারের বেড়া থাকবে না। দু’বাংলা এক হয়ে যাবে। দুই বাংলার কত বাঙালি জন্মগ্রহণ করেছে সবাই বাংলায় কথা বলেন। দুই বাংলায় কত নামি দামি কবি সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্রোপাথ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষার জন্য রফিক, সালাম ও বরকত শফিক জীবন দিয়েছেন।
তিনি ঢাকার চকবাজারে আগুনে পুড়ে ৭০ জনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, তাদের পাশে থাকতে না পারলেও দূর থেকে সমবেদনা জানাচ্ছি।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, দুই বাংলার মানুষ আজ আমরা এক হয়েছি। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন আমাদের অধিকার বোধের জম্ম দিয়েছিল। সালাম, বরকত, রফিক, শফিক জব্বারসহ হাজারো মানুষের রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষার যে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বিশ্বে বিরল।
ভাষা শহীদদের স্মরণে দু’বাংলার মানুষের সম্প্রীতি আর ভালোবাসার বাধনকে আরও সুদৃঢ় করার প্রত্যয় নিয়ে শেষ হয় ভাষা প্রেমিদের মিলন মেলা। সমগ্র অনুষ্ঠানে নেয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তা। কড়াকড়ি আরোপ করা হয় দুই সীমান্তে। বেনাপোল পেট্রাপোল চেকপোস্টে যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বিজিবি ও বিএসএফ অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করে দুই সীমান্তে। সীমান্ত টপকে যাতে কেউ অবৈধভাবে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বিজিবি ও বিএসএফ বাঁশের বেস্টনি দিয়ে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
২০০২ সাল থেকে দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল চেকপোস্টের জিরো পয়েন্টে মাতৃভাষা দিবস পালন করে আসছে দু’বাংলার মানুষ। এছাড়া আয়োজনস্থলে বর্ণমালা গ্যালারি, বইমেলা ও বাংলাদেশের একশ’ স্বেচ্চাসেবী স্বেচ্ছায় রক্ত দান করেন। যা ভাষা উৎসবকে প্রাণবন্ত এবং দুই বাংলার মানুষকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে।