বরিশালের সড়ক-মহাসড়কে দিন দিন বেড়েই চলছে দুর্ঘটনা। এর কারণও মোটামুটি চিহ্নিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো স্থায়ী সমাধানে আসতে পারছে না।
অনেকের দাবি পুলিশ ও বেশ কয়েকজন নেতার কারণেই এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
বিশ্বস্ত কয়েকটি সূত্র বলছে, গত ৩ বছরে বরিশালের সড়ক-মহাসড়কে যেসব দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগ কারণই হচ্ছে থ্রি হুইলার মাহিন্দ্রা। লাইসেন্সবিহীন চালকরা বেপরোয়া গতিতে এ যান চালানোর কারণেই দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি করছেন অনেকে।
বরিশালের বাস চালকরা জানান, হাইকোর্ট থেকে মহাসড়কে থ্রি হুইলার যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হলেও এগুলো বীর দর্পে চলছে। সিগন্যালের বালাই নেই এ যান চালকদের কাছে। যে যার ইচ্ছামতো চালাচ্ছে, ওভারটেক করছে।
বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন দপ্তর অবগত থাকলেও কোনো সমাধান হচ্ছে না। যে কারণে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এতে করে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। পঙ্গুত্ব গ্রহণ করেছেন অনেকে।
সম্প্রতি গড়িয়ারপারে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭ জন। আর যারা আহত হয়েছেন তাদের সুস্থ হতেও অনেক সময় লাগবে। বেপরোয়া গতির এ যানবাহন বরিশালের ব্যস্ততম সড়কগুলো থেকে সরিয়ে দেয়া উচিত। বিশেষ করে দূরপাল্লার রুটগুলো থেকে।
বাস শ্রমিকদের অভিযোগ, ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে মহাসড়কে থ্রি হুইলার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও সেই নিষেধাজ্ঞা কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। পুলিশের নাকের ডগা দিয়েই চলছে এসব যান। অভিযোগ রয়েছে মহাসড়কে এই থ্রি হুইলার মাহিন্দ্রা চললে মাসোহারা পায় পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা। আর যার পেছনে শেল্টারদাতা হিসেবে রয়েছে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা। যে কারণে নিষেধাজ্ঞা কাগজে-কলমেই চাপা পড়ে রয়েছে। আর এতে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার।
বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক হয়ে প্রায় ১৪ রুটে ঝুঁকিপূর্ণভাবে থ্রি হুইলার মাহিন্দ্রা চলাচল করে। এছাড়া রুপাতলী বাস টার্মিনাল থেকে ঝালকাঠি, বাকেরগঞ্জ, নলছিটি ও লাহারহাট রুটে চলাচল করে থ্রি হুইলার মাহিন্দ্রা।
এসব রুটে প্রায় দুর্ঘটনার খবর শোনা যায়। যেগুলো বেশিরভাগই থ্রি হুইলারের কারণে হয়ে থাকে। বাস ও ট্রাকের সঙ্গে থ্রি হুইলার যান পাল্লা দিয়ে চলাচলের চেষ্টা করে। আর এতেই ঘটে দুর্ঘটনা।
নথুল্লাবাদের বাস শ্রমিক শাওন জানান, বরিশাল থেকে যে কয়টি রুটে বাস চলাচল করে সেই রুটগুলোতেই এই মাহিন্দ্রা চলাচল করে থাকে। যেমন বরিশাল টু ভুরঘাটা, মাদারীপুর, গৌরনদী, বানারীপাড়া, ধামুরা, সাতলা, বাকেরগঞ্জ, ঝালকাঠি, নলছিটি, লাহারহাট, বাবুগঞ্জ, মুলাদী, মীরগঞ্জসহ আরো বেশ কয়েকটি রুট। বেপরোয়া গতিতে চালানোর কারণেই মাহিন্দ্রাগুলো দুর্ঘটনায় পড়ে। আর এদের বিরুদ্ধে সহসা পুলিশ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করে না। শুনেছি মাসে মাসে টাকা দেয়া হয় মাহিন্দ্রাগুলো থেকে তাদের। আর এ কারণেই তাদের কিছু বলা হয় না।
এদিকে মাহিন্দ্রা চালক ছত্তার মিঞা বলেন, মাহিন্দ্রার বেশিরভাগ চালকের লাইসেন্স আছে। লাইসেন্স না থাকলে তো পুলিশ মামলাই দিতো। বরিশাল নগরী থেকে আমাদের গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তাহলে এখন আমরা গাড়ি চালাবো কোথায়। আর আমরা তো গাড়ি মহাসড়কে চালাই না।
বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. ইউনুস আলী খান জানান, থ্রি হুইলার মাহিন্দ্রার কারণে বাস চালানো দুষ্কর হয়ে উঠেছে। বেপরোয়া গতির কারণে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। আর এ যানগুলোর বেশির ভাগ চালকেরই নেই লাইসেন্স ও প্রশিক্ষণ। হাইওয়েতে চালানো অবস্থায় মানুষ যেখানে বসে সিগন্যাল দেয় সেখানেই দাঁড়িয়ে যায় এই থ্রি হুইলারগুলো।
তিনি বলেন, মহাসড়কে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানোয় ইতিমধ্যে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই নিয়ে প্রশাসনের কাছে আমরা অনেক বলেছি। তবে কোনো সমাধান পাচ্ছি না।
ইউনুস আলী খান বলেন, নিষেধজ্ঞার পরও এই মাহিন্দ্রাগুলো যেভাবে চলাচল করছে তাতে সামনে আরো প্রাণহানি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। যে বিষয়টি আমরা মাসিক আইন শৃঙ্খলা সভায়ও বলেছি।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বরিশাল জেলা মাহিন্দ্রা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কামাল হোসেন মোল্লা লিটনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপ কমিশনার খায়রুল আলম বলেন, মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলাচল বন্ধে আমরা কন্টিনিউ মামলা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু মূলকথা হচ্ছে শহরের মধ্যে থেকে যদি একটি বাইপাস সড়ক থাকতো তাহলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য ভালো হতো। আর এ গাড়িগুলো মহাসড়কে চলাচল করতো না।
জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম জানান, ‘মহাসড়কে মাহিন্দ্রা বা থ্রি হুইলার যান চলাচলের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে জেলা পুলিশ। তবে এগুলো যে মহাসড়কে একেবারেই চলে না সেটা বলব না। আর আমাদের সামনে পড়লে এই যানগুলোর বিরুদ্ধে মামলা থেকে শুরু করে বিপুল অংকের টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি যদি কোনো অফিসার টাকার বিনিময়ে এ যানগুলো ছেড়ে দেন তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া রয়েছে।
তিনি জানান, মূল বিষয় হচ্ছে আমাদের আরো সচেতনতা দরকার। এই থ্রি হুইলার যানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে দ্রুতগামী বাস বা ট্রাকের সড়কে নয়।