বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে কবির সিকদার (৪০) নামে চুরি মামলার সাজাপ্রাপ্ত এক কয়েদির রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার (০১ মার্চ) দুপুর সোয়া ১টার দিকে কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিভিশন ভবনের রান্না ঘরের স্টোর রুম থেকে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
কারা কর্তৃপক্ষের দাবী গলায় ফাঁস দিয়ে ওই কয়েদি আত্মহত্যা করেছে। তবে সূত্র বলছে ভিন্নটা। কতিপয় কয়েদির নির্যাতনে ওই কয়েদির মৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া মৃত্যুর এক দিন পূর্বে অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে কয়েদি কবির সিকদারকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে স্বয়ং জেলারের বিরুদ্ধে। তবে নির্যাতনের অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবী করেছেন জেলার মো. ইউনুস জামান।
নিহত কয়েদী কবির সিকদার (কয়েদী নং-৫৩২৯/এ) পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার জামিরতলা গ্রামের দলিল উদ্দিন সিকদারের ছেলে। ভোলার মনপুরা থানায় ( দন্ডবিধি ৩২৮/৩৮০ ধারা) চুরি মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামী। ২০১৮ সালের ২ আগস্ট থেকে তিনি চিকিৎসা জনিত কারনে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্ধি হিসেবে ছিলেন।
লাশ উদ্ধারকারী বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মো. ইউনুস জামান জানান, ভোলা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত চুরি মামলায় পৃথক দুটি ধারায় কবির সিকদারকে পাঁচ বছর করে ১০ বছরের কারাদন্ড দেয়। সেই থেকে কবির ভোলা কারাগারেই ছিলো। বুকে ব্যথা জনিত কারনে সেখানে তাকে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে চিকিৎসার জন্য প্রেরন করা হয়। এর পর তাকে কিছুদিন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিলো। কারাগারে ফিরে আসার পরে সে ঝাড়ু দফা (ঝাড়ুদার) হিসেবে কাজ করতো।
বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কবির সিকদার ঝাড়ু দফা (ঝাড়ুদার) এর কাজ দেয়ার জন্য জেলার ইউনুস জামান এর সাথে ৫/৭ সাত হাজার টাকার চুক্তি হয়। এই চুক্তির মধ্যস্ততা করেন হাজতী ব্যাঞ্চের দায়িত্বে থাকা কারারক্ষি কাওসার।
গোপন সূত্রটি জানায়, চুক্তির পর কবির সিকদার কাজ শুরু করলেও সে টাকা পরিশোধ করেনি। সম্প্রতি ওই টাকার জন্য জেলারকে চাপ দেন এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। যা জেলারের সম্মানের হানি ঘটনায়। এজন্য বৃহস্পতিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টার পরে যে কোন সময় মধ্যস্ততাকারী কারারক্ষি কাওসারের মাধ্যমে কয়েদী কবির সিকদারকে নিজ কার্যালয়ে ডেকে আনেন জেলার ইউনুস জামান। সেখানে টাকা দিতে দেরি হওয়ায় জেলার কয়েদী কবিরকে মারধর করে বলে অভিযোগ উঠেছে।
তবে জেলার ইউনুস জামান বলেন, দুপুরে কয়েদী কবির সিকদারকে কারা অভ্যন্তরে তার ওয়ার্ডে (এলাকায়) খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। পরে কারাগারের ডিভিশন ভবনের রান্না ঘরের স্টোর রুমের আড়ার সাথে কয়েদী গামছা গলায় পেচানো অবস্থায় তাকে ঝুলতে থাকতে দেখা যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে কারাগারের হাসপাতালে নিয়ে যাই। তখনও ওই কয়েদী জীবীত ছিলো। কারা হাসপাতালের চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টদের সাথে কথা বলে তাকে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে পাঠানো হলে জরুরী বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন।
ইউনুস জামান বলেন, গত ৭/৮ বছর ধরে ডিভিশনাল ভবনে কোন কয়েদী আসছে না। তাই ওই ভবনটি এক প্রকার পরিত্যাক্ত অবস্থাতেই রয়েছে। তাছাড়া ভবনটির সামনে এবং ভেতরের দরজায় তালা দেয়া রয়েছে। যাতে কেউ ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। যতটুকু ধারনা করা হচ্ছে ভবনের সীমানা প্রাচীরের পাশে থাকা কাঠাল গাছ বেয়ে ওই কয়েদী ভেতরে প্রবেশ করে। আর ভেতরে থাকা রান্না ঘারের বেড়া ভাঙা থাকায় সেখান থেকেই সে রান্না ঘরের স্টোর রুমে প্রবেশ করে গলায় ফাঁস দিতে পারে।
তিনি বলেন, এটি প্রকৃত আত্মহত্যা কিনা সে বিষয়টি আমিও নিশ্চিৎ নই। ময়না তদন্ত করলে এর প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে। তবে এটি যে নির্যাতনের ঘটনা নয় সেটা আমরা নিশ্চিত। কেননা বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে এখন পর্যন্ত এক হাজার ২৩৮ জন কয়েদী রয়েছে। নির্যাতনের কোন ঘটনা ঘটে থাকলে অবশ্যই সেটা কেউ না কেউ দেখতো।
তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে তাকে মারধরের যে অভিযোগ তোলা হয়েছে সেটাও ঠিক নয়। কেননা কবির শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসা শেষ করে এই কারাগারে আসার পরে গত ৮/৯ মাসে তাকে কোন টাকা দিতে হয়নি। তাছাড়া আমি এখানে দায়িত্ব গ্রহনের পর থেকে অনিয়ম সহ সকল ধরনের অর্থনৈতিক লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছি। এটার জন্যও কেউ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে।
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শী কারা হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট নাসির উদ্দিন বলেন, কারাগারের চিকিৎসক ডা. খুর্শিদ আলম ঘটনার সময় কারাগারে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি বর্তমানে ঢাকায় রয়েছেন। তাই আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পাই মৃতদেহ ডিভিশন ভবনের মেঝেতে পড়ে আছে। আমার ঘটনাস্থলে পৌছাবার আগেই হয়তো তাকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে তখন সে মৃত অবস্থায় ছিলো। এর বেশি কিছু জানেন না বলে দাবী করেছেন ফার্মাসিস্ট নাজির উদ্দিন।
অপরদিকে কয়েকদী কবির সিকদারকে মৃত ঘোষনা করা শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের দায়িত্বরত ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার (ইএমও) ডা. আমিরুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই ওই কয়েদীর মৃত্যু হয়েছে। যারা মৃতদেহ নিয়ে এসেছে তারা আমাকে জানিয়েছে এটি আত্মহত্যা। তবে এটি সত্যিই আত্মহত্যা কিনা সে বিষয়টি আমি নিশ্চিত নই। এটি ময়না তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
এদিকে কোতয়ালী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আসাদুজ্জামান বলেন, খবর পেয়ে আমি এবং আমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাসপাতালের মর্গে লাশ প্রত্যক্ষ করেছি। কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে এটি আত্মহত্যা। তবে কারাগারের ভেতরে আত্মহত্যার সুযোগ হলো কিভাবে সে বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবেন। তাই বিষয়টি নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বনিক বলেন, আত্মহত্যার পেছনে নির্যাতনের কোন কারন থাকতে পারে না। হতে পারে সে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় আত্মহত্যা করেছে। তবে এই ঘটনায় কারো দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ পেলে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান এর সাথে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় কারাগারে কয়েদির আত্মহত্যার খবর পেয়েছি। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা নেই। খোঁজ খবর নিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।