কারিগরি সমস্যার কারণে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’ এর উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হলেও আজ (শুক্রবার) ফ্লোরিডার স্থানীয় সময় ৪টা ২০ মিনিটে আবারও উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি নিচ্ছে কেনেডির স্পেস সেন্টার। সব কিছু ঠিক থাকলে নির্দিষ্ট সময়েই ‘বঙ্গবন্ধু-১’ স্যাটেলাইট বহনকারী রকেটটি উৎক্ষেপণ করা হবে।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি মহাকাশে ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করবে। ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাশিয়ান ইন্টারস্পুটনিকের আওতাধীন কক্ষপথটি (অরবিটাল স্লট) ভাড়া নেয়ার বিষয়ে রাশিয়ার সাথে চুক্তি করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। ১৫ বছরের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে এ অরবিটাল স্লট ভাড়া নেয়ার পর ওই বছরই ‘বঙ্গবন্ধু-১’ উৎক্ষেপণে মূল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল (এসপিআই) কাজ শুরু করে।
থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটির জন্য কেনা কক্ষপথটি ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে হলেও বাংলাদেশের অবস্থান ৯০ ডিগ্রির আশপাশ ঘিরে। এ কারণে বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহের কভারেজ অঞ্চল হবে কিছুটা পূর্বমুখী। ফলে স্যাটেলাইটটির আওতায় থাকবে ভারতের মুম্বাই থেকে ফিলপিনের মিন্দানাও দ্বীপ পর্যন্ত।
বঙ্গোপসাগরের পুরো এলাকাসহ এ সীমানার ভেতরে থাকবে ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়ায় ও ফিলিপাইনের বিস্তির্ণ এলাকা। এছাড়া তুর্কিমেনিস্থান ও কাজাখাস্থানের কিছু অংশও বঙ্গবন্ধু-১ এর কভারেজ অঞ্চল হিসেবে পরিগণিত হবে। এসব এলাকায় বঙ্গবন্ধু-১ ‘কিউ-ব্যান্ড’ কভারেজ এবং ‘সি-ব্যান্ড’ সুবিধা প্রদান করবে।
ব্যবসায়িক কারণে স্যাটেলাইটটি পূর্বমুখী অবস্থানের স্লট কেনা হয়েছে বলা হলেও একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বাংলার মুখকে জানায়, বাংলাদেশের অবস্থানকে ঘিরে কোনো স্লট খালি না থাকায় পূর্ব দিকে সরে গিয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে স্লটটি নেয়া হয়। এছাড়া অবস্থানগত কারণে মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলোর সাথে যোগাযোগে সমস্যা হলেও কোনো উপায়ও ছিল। কারণ, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্লট নেয়ার প্রস্তাব করা হলে সে সময় বিভিন্ন দেশ থেকে আপত্তি তোলা হয়।
ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নে (আইটিইউ) অরবিটাল পজিশন ৬৯ ও ১০২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে পাওয়ার জন্য ২০০৭ সালে আবেদন করেছিল বাংলাদেশ। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েল, জাপান, সাইপ্রাস, আর্মেনিয়া ও উজবেকিস্তান তাতে আপত্তি জানায়। প্রক্রিয়াগত কারণে এ ধরনের আপত্তি অস্বাভাবিক না হওয়ায় ইন্টারস্পুটনিকের সঙ্গে সমঝোতায় আসে বাংলাদেশ।
থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস বলছে, স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্দু-১’ থেকে রাজস্ব আয় করে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে বাংলাদেশ। বর্তমানে ব্রডকাস্টিং সেবা পেতে বিদেশি উপগ্রহ থেকে ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নিতে হয়। বঙ্গবন্ধু-১ চালু হলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচার পরিষেবার দেশের কর্তৃত্ব অর্জন করবে। একই সঙ্গে নেপাল, মিয়ানমার বা ভুটানের মতো বিভিন্ন বিদেশি দেশগুলোতে সরবরাহের সুবিধা প্রদান করতে পারবে।
মহাকাশ গবেষক মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব জানান, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার নিজস্ব স্যাটেলাইট রয়েছে। মিয়ানমার সম্প্রতি বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ শুরু করেছে। নেপাল ও ভুটানও কাজ করছে ন্যানো স্যাটেলাইট নিয়ে। এছাড়া অনেক দেশেরই নিজস্ব স্যাটেলাইট নেই। মহাকাশে ৪০টি দেশের হাজারেরও বেশি স্যাটেলাইট থাকলেও এর মধ্যে অব্যবহৃতই রয়েছে শ’খানেক। মহাকাশে এখন পর্যন্ত ছয় হাজার ৬শ’ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপিত হয়েছে। আর এর সাথে যোগ হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’।
তিনি আরও জানান, দেশে বর্তমানে চলমান টেলিভিশন চ্যানেল, টেলিফোন ও রেডিওগুলোর ক্ষেত্রে বিদেশি স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। এ কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশকে প্রায় ১১০ কোটি টাকা ভাড়া গুণতে হয়। বঙ্গবন্ধু-১ চালু হলে দেশের এ টাকা সাশ্রয় হবে এবং একই সঙ্গে নিজস্ব স্যাটেলাইট ব্যবহার করে টিভি ও রেডিও চ্যানেল, টেলিফোন, মোবাইল, ইন্টারনেট সেবা, নেভিগেশন জ্যোতিবিজ্ঞান গবেষণা, সামরিক প্রয়োজনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুফল পাবে বাংলাদেশ।
এছাড়া মাটি বা পানির নিচে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজ, ছবি তোলা, সংবেদনশীল তথ্যাদি, ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস,
পারমাণবিক বিস্ফোরণ ও আসন্ন হামলা ছাড়াও সেনাবাহিনী ও অন্যান্য ইন্টেলিজেন্স সম্পর্কে আগাম সতর্কবার্তা, খনিজ পদার্থ ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করাসহ অত্যাধুনিক অনেক কাজে বাড়তি সুবিধা বয়ে নিয়ে আসবে দেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১।