‘শুকনা ধান সরকারি গুদামে নিয়া গেলেও তারা কয় ভিজা। যাদের স্লিপ আছে, তারা ভিজা ধান এক হাজার ৪০ টাকা মণ বেচতাছে। একটু বেশি দামে ধান বেচার লাইগ্যা কত নেতার পিচে ঘুরলাম, তবু তারা স্লিপ দিল না। খাদ্যগুদামের ম্যানেজারের মোবাইল খালি বন্ধ থাকে। নৌকার লোক হইয়াও ধান বেচার স্লিপ পাইলাম না।’ আক্ষেপের সঙ্গে কথাগুলো বলেন নেত্রকোনার কলমাকান্দার গৌবিন্দপুরের কৃষক ছামাদ আলী। শুধু এই কৃষকই নন, তার মতো অন্য কৃষকরাও একই অবস্থার শিকার। তারাও সরকারি গুদামে ধান বেচতে পারছেন না।
ধানের দরপতন ঠেকাতে গত মাসের ২৬ তারিখে সরকারিভাবে ধান-চাল কেনা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে শুরু হয়। চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবার বোরো মৌসুমে সাড়ে ১২ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহ করা হবে। কিন্তু অভিযানের শুরু থেকেই ক্ষমতাসীনদের কবজায় চলে যায় ধান সংগ্রহ অভিযান। নেতা ধরেও কৃষকরা সরকারি গুদামে ধান দিতে পারছেন না। শুধু সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতারাই ধান সরবরাহ করতে পারছেন। ধান বেচার স্লিপও থাকছে তাদের হাতে। ওই সব নেতা রাতারাতি হয়ে উঠেছেন কৃষক। তারা কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে সরকারি গুদামে বেশি দামে বিক্রি করছেন। তাই সরকারের ধান কেনায় কৃষক নয়, নেতারাই বেশি লাভবান হচ্ছেন। অনেকেই মনে করেন, ধান-চাল সংগ্রহ নীতিমালা পরিবর্তন না হলে সরকারের এ সহায়তা কৃষকের কাছে পৌঁছাবে না।
সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানে রাজনৈতিক প্রভাব থাকার কথা স্বীকার করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। তার মতে, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান মনিটর করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানিয়েছেন, ধান কেনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বরদাশত করা হবে না।
বাজারে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে চারশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকায়। নেতারাও কৃষকদের কাছ থেকে ওই দামে ধান কিনছেন। সেই ধান সরকারি গুদামে সরবরাহ করে তারা প্রতি মণে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। অনেক জেলা-উপজেলায় স্থানীয় নেতাদের মধ্যে ধান-বাণিজ্য ও ধানের স্লিপ বিক্রির টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে অন্তর্কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের চাপে তাদের কাছ থেকে ধান নিতে তারা বাধ্য হন।
বিভিন্ন এলাকার কৃষক জানান, তারা ধান নিয়ে খাদ্যগুদামে গেলে ধানে চিটা ও পরিস্কার না, ধানে আর্দ্রতা কমবেশি, গুদাম খালি নেই- এমন অজুহাত দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ প্রকাশ্যে নেতাদের স্লিপে ভেজা ধান নেওয়া হচ্ছে। অনেক এলাকায় নেতারা কৃষকের কৃষি কার্ডও রেখে দিচ্ছেন। সেই কার্ড দিয়েই তারা সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করছেন। ওই সব প্রভাবশালী নেতা ভুয়া নামেও সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করছেন। আর চালকল মালিকরা আমদানি করা পুরনো নিম্নমানের চাল সরকারি গুদামে দিচ্ছেন।
১৯ মে বরিশালের গৌরনদী উপজেলা ভারপ্রাপ্ত খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র পালকে জিম্মি করে নিম্নমানের চাল নিতে ৩৬ লাখ ৭২০ টাকার চেক লিখে নেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান ফরহাদ মুন্সী। এ ঘটনায় সোমবার ওই কর্মকর্তা ইউএনও খালেদা নাছরিনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এরই মধ্যে এক হাজার ১২০ টন চাল সরবরাহের বরাদ্দ পেয়েছেন এলাহী অটো রাইস মিলের মালিক নুরুজ্জামান ফরহাদ মুন্সী। এ বিষয়ে ফরহাদ মুন্সী বলেন, ১৯ মে উপজেলা ভারপ্রাপ্ত খাদ্যগুদাম কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার বিল পাওনা আছে। বিল ওঠানোর জন্য চেক নিয়ে এসেছি। হুমকি বা ভয়ভীতি দেখানোর কোনো ঘটনা ঘটেনি।
সিরাজগঞ্জের বেলকুচির যুবলীগের আহ্বায়ক ও উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সাজেদুলের ছোট ভাই সাজ্জাদুল হক রেজা ও পৌর শ্রমিক লীগের সভাপতি আরমানসহ তাদের পাঁচজনের ধান না কেনায় ২২ মে ইউএনও এস এম সাইফুর রহমানকে গালাগাল করা হয়; হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। এরপর তারা খাদ্যগুদামে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সরবরাহে বাধা দেন। বেলকুচি থানার ওসি আনোয়ারুল ইসলাম জানান, এ ঘটনায় আরমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ইউএনও মামলা করেছেন।
টাঙ্গাইলে সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয়ভাবে চাতালকল মালিকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকলেও খাদ্যগুদামের কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সরকারদলীয় নেতাদের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চাল সংগ্রহ করছেন। মির্জাপুর খাদ্যগুদামে এক হাজার ৪৮২ টন চাল সংগ্রহ করার কথা। চাতালকল মালিকরা স্থানীয়ভাবে নতুন ধান ক্রয় করে চাল বানিয়ে সরকারি খাদ্যগুদামে সরবরাহ করার চুক্তি করলেও তা করেননি। দেওহাটা বাজারের ইন্নছ রাইস মিলে ছয় মাস ধরে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কিন্তু ১৩ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত চারবার মিলটির নামে ৬৫ টন চাল সরবরাহ করা হয়েছে। একইভাবে উপজেলার কদিম ধল্যার মেসার্স কাজী রাইস মিল, মেসার্স থ্রি ব্রাদার্স রাইস মিল ও মেসার্স হেলাল উদ্দিন রাইস মিল বন্ধ থাকলেও তাদের নামে ২২৫ টন চাল ক্রয় দেখানো হয়েছে। মির্জাপুর উপজেলার দেওহাটা বাজারের ইন্নছ রাইস মিলটির মালিক মির্জাপুর উপজেলা চাতালকল মালিক সমিতির সভাপতি ও পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোয়াজ্জেম হোসেন। এসব অনিয়মের বিষয়টি উঠে এলে বৃহস্পতিবার খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) পরিমল চন্দ্র সরকার ও পরিচালক (সংগ্রহ) জুলফিকার আলী পরিদর্শন করেন। তদন্তে কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
জানা যায়, নেত্রকোনার খালিয়াজুরীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মেন্দিপুর ইউপি চেয়ারম্যান লোকমান হেকিম, আইয়ুব আলী, তোফাজ্জল হোসেন, মৌলা মিয়াসহ বেশ কয়েকজন সরকারি দলের নেতা খাদ্যগুদামে কৃষি কার্ডের মাধ্যমে ধান দিয়েছেন।
মাদারীপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে চাল সংগ্রহ অভিযানের আগেই রাজৈরের টেকেরহাট খাদ্যগুদামে ৪০০ টন চাল কেনা হয়েছে। ১৪ মে বোরো চাল সংগ্রহ অভিযানের উদ্বোধন করতে গিয়ে রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহানা নাসরিন তা জানতে পারেন। এ ঘটনায় ভারপ্রাপ্ত গুদামরক্ষক গাজী সালাহ উদ্দিনকে সতর্ক করা হয়। সেখানকার কৃষকরা জানিয়েছেন, নেতারা আগেই আমদানি করা চাল দিয়ে গুদাম ভরে রেখেছেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান বলেন, উৎপাদনের সামান্য অংশ কিনে কৃষকদের লাভবান করা যাবে না। তারপরও সরকার পড়তি বাজারের লাগাম টেনে ধরতে ধান কেনা শুরু করেছে। কিন্তু এতে কৃষক নয়, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের পকেটে টাকা চলে যাচ্ছে।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান সব সময় প্রভাবশালীদের দখলেই থাকে। তবে চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকদের শর্ত দেওয়া যেতে পারে- তারা আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বাজার থেকে ধান কিনবেন। তা হলে বাজারে ধানের দাম বাড়বে। প্রভাবশালীদেরও দাপট কমবে।
বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে ক্রয়কেন্দ্র চালু করে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা উচিত। সরকার নির্ধারিত ধানের দাম কৃষকরা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কৃষকের এ মূল্য সরকারি দলের নেতা লুটপাট করে নিচ্ছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশের কৃষক দুর্যোগের মধ্যে আছে। এমন সময় সরকারের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছে। সরকারের এ উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা। সরকারের উচিত তাদের শাস্তি দেওয়া।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, প্রকৃত কৃষক ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে ধান না কেনার জন্য প্রশাসনকে কড়াভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলীয় মধ্যস্বত্বভোগীরা যেন ফায়দা লুটতে না পারে, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা তদারকির জন্য মনিটরিং টিম কাজ করছে। পূর্বঘোষণা ছাড়াই বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করছে মনিটরিং টিম। তিনি বলেন, ধান ও চালের মজুদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশে ২০০ স্থানে প্যাডি সাইলো স্থাপন করা হবে। প্যাডি সাইলো নির্মাণ করা হলে কৃষক সেখানে নিজের ধান শুকিয়ে বিক্রি করতে পারবেন।
এ বছর এক বিঘা বোরো জমি চাষ করতে কৃষকের খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। ধান উৎপাদন হয়েছে প্রতি বিঘায় ১৫ মণের মতো। হাটে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ধরে ধান বিক্রি করতে পারছেন কৃষক। প্রতি বিঘায় কৃষকের লোকসান সাড়ে ছয় হাজার টাকা। এ ছাড়া একজন কৃষি শ্রমিকের পারিশ্রমিক হিসেবে প্রতিদিন ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা মজুরি দিতে হচ্ছে।