ঢাকা থেকে অপহরণ হওয়ার ২৬ দিন পর অবশেষে বিনা মুক্তিপণে নিজ বাড়ি ফিরেছেন ভোলার বোরহানউদ্দিনের আমজাদ।
সোমবার সকালে জীর্ণ-শীর্ণ শরীরে বাড়ি এসে পৌঁছালে আনন্দ অশ্রুতে বরণ করেন তার মা ফয়জুননেছা, স্ত্রী লুবনা, ৩ বছরের শিশু সন্তান এবং তার অন্যান্য স্বজনরা।
এর আগে গত ২ মে ঢাকার ফুলবাড়িয়া মার্কেটে তৈরি পোশাক কিনতে গেলে ফুলবাড়িয়া ওভার ব্রিজের কাছ থেকে আমজাদকে অপহরণ করা হয়। পরে অপহরণকারীরা আমজাদের স্বজনদের কাছে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
আমজাদ বোরহানউদ্দিন উপজেলার পক্ষিয়া ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে আমজাদ সবার ছোট। তিনি তার বাড়ির কাছে উদয়পুর-নবাব মিয়ার হাট সড়কে তৈরি পোশাকের ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন।
সোমবার দুপুরে আমজাদের বাড়িতে গেলে তিনি জানান, চলতি (মে) মাসের ১ তারিখে তার প্রতিবেশী জুয়েলসহ দোকানের মাল কিনতে ৬১ হাজার ৫০০ টাকা নিয়ে ঢাকার লঞ্চে ওঠেন। সদরঘাটে নেমে জুয়েল চাকরির ইন্টারভিউ দিতে চলে যায়। আর আমজাদ ফুলবাড়িয়া মার্কেটের একটি পাইকারি দোকান থেকে প্রথমে ১২ পিস স্যান্ডো গেঞ্জি কেনেন।
দোকান থেকে বের হওয়ার পর এক লোক সামনে এসে জিজ্ঞেস করে আপনার বাড়ি কোথায়। ভোলা বলার পর ওই লোকও তার বাড়ি ভোলা দাবি করে গেঞ্জি কেনার মেমো দেখতে চায়। মেমো দেখে ওই লোক থ্রি-পিসসহ অন্যান্য মালামাল কী দরে কিনেছেন তা জানতে চায়। এ সময় আমজাদ দর জানান।
ওই লোক বলে এরা সব মালের দাম বেশি রাখে। পাশের আরেক মার্কেটে দাম অনেক কম। এমন কথা বলে নিজেও পাশের মার্কেট থেকে মাল কিনবে বলে আমজাদকে ওই লোক তার সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়।
পরে ফুলবাড়িয়া ওভারব্রিজের নিচে তারা একটি রিকশায় ওঠেন। হঠাৎ ওই লোক তার মুখে একটি রুমাল ধরলে আমজাদ অচেতন হয়ে যান। ওই দিন বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে আমজাদ নিজেকে একটি বন্ধ ঘরে আবিষ্কার করেন।
তার পাশে দেখেন পাঞ্জাবি-টুপি পরিহিত একজন হুজুর। ওই সময় তার প্রচুর বমির বেগ হয়। বাথরুমে বমি করে আবার ফ্লোরে ঘুমিয়ে পড়েন আমজাদ। ঘুম ভাঙ্গলে আর হুজুরকে দেখা যায়নি। ওই লোক তিনদিন ধরে তার মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের পিন কোড ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার বলার জন্য নির্যাতন করে। তিনদিন পর ওই লোকের পরিবর্তে আরেক লোক আসে।
আমজাদ আরও জানান, তাকে দিনে দু’বেলা অল্প ভাত অথবা রুটি দেয়া হত। তবে রুটির সঙ্গে ভাজি বা ডালের বেশি কিছু জুটত না। মোবাইল ফোনে ওদের কথা-বার্তা শুনে বুঝা গেছে স্থানটি টঙ্গি এলাকার মন্নুনগরের ৭তলা কোনো ভবন। তাদের একজন বস আছে। সে বর্তমানে ভারতে।
১৯ দিনের মাথায় তাকে ৩ লাখ টাকা দিতে তার স্ত্রী লুবনা ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মহিউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে দেয়া হয়। ২৫ দিনের মাথায় একজন নারী ওই রুমে আসেন। ওই নারী তাকে তার নাম, ঠিকানা, আর্থিক অবস্থা, সঙ্গে কত টাকা ছিল, মোবাইল ফোন সঙ্গে ছিল কিনা- এসব জিজ্ঞেস করেন।
পরে ওই নারী রুম রক্ষককে বলেন, তোমাদের ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ওকে (আমজাদ) কাল সকালে ছেড়ে দিবে। মোবাইল দিয়ে দিবে। পরদিন সকালে তাকে চোখ বেঁধে মুখে মাস্ক পরিয়ে রুম থেকে বের করা হয়।
আমজাদ বলেন, তারা প্রাইভেটকারে উঠিয়ে টঙ্গি স্টেশন রোডে নামিয়ে দিয়ে তার মোবাইল ফোন হাতে দেয়। এ সময় রুম রক্ষক বলেন, তোর ভগ্নিপতিকে কল দিয়ে গুলিস্তানের দিকে চলে যা। তারপর বাসে উঠে ভগ্নিপতি ইসমাইলকে কল দিয়ে গুলিস্তানে তার কাছে চলে আসি।
আমজাদের ভগ্নিপতি ইসমাইল ও ওয়ার্ড ইউপি মেম্বার মহিউদ্দিন বলেন, আমজাদকে অপহরণের ৩ দিন পর থেকেই ওই সংঘবদ্ধ চক্র মুক্তিপণ হিসেবে ৩ লাখ টাকা দাবি করে আসছিল। আমরা বোরহানউদ্দিন, ঢাকার টঙ্গি, মতিঝিল ও কোতোয়ালি থানায় জিডি করতে যাই। কিন্তু ওই থানাগুলো তাদের এলাকার ঘটনা না বলে জিডি নেয়নি।
অবশেষে কোতোয়ালি থানা জিডি নিয়ে র্যাব-১, থানা-পুলিশসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সাহায্য চাই। লোকেশন ট্র্যাক করে র্যাব-পুলিশ আমজাদের অবস্থান জানায়। কিন্তু তারা অপারেশনে যায়নি। এর ভেতর অপহরণকারীরা টাকার যতোই চাপ দিচ্ছিল আমরা প্রথমে অপারগতার কথা জানাই।
এক পর্যায়ে দর-দাম করতে থাকি। আমজাদ বেঁচে আছে কিনা এজন্য তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমজাদ বেঁচে আছে জেনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বার বার ধর্ণা ধরি। এক পর্যায়ে র্যাব-১ এলাকার লোকেশন দিলে টঙ্গি থানা পুলিশ আমজাদকে আটকে রাখা এলাকায় যায়। কিন্তু একই রকম বেশ কয়েকটি ৭তলা ভবন থাকায় পুলিশ অপারেশনে যায়নি। অপহরণকারীরা হয়তো ধরা পড়ে যাবার ভয়ে আমজাদকে ছেড়ে দিয়েছে, বলেন আমজাদের ভগ্নিপতি ইসমাইল ও ওয়ার্ড ইউপি মেম্বার মহিউদ্দিন। আমজাদের স্ত্রী লুবনা বলেন, ফোনে অপহরণকারীদের ৩ লাখ টাকা না দিলে তার স্বামীকে মেরে ফেলার ক্রমাগত হুমকিতে নাওয়া-খাওয়া সব ভুলে গেছি। এখন অনেক ভালো লাগছে।
আমজাদের মা ফয়জুননেছা বলেন, এ কয়দিন আল্লাহর কাছে শুধু আমার মানিককে ফিরিয়ে দেয়ার দোয়া করেছি। আল্লাহ দরবারে লাখো-কোটি শুকরিয়া।