28 C
Dhaka
জুলাই ৭, ২০২৫
Bangla Online News Banglarmukh24.com
আন্তর্জাতিক প্রচ্ছদ রাজণীতি

ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধী যুগের অবসান

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশাল জয় ঘোষিত হচ্ছিল, তখন ভারতের অন্যতম প্রাচীন দল কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী হয়ে পড়ছিলেন বিধ্বস্ত। নেহরু-গান্ধী পারিবারের সর্বশেষ উত্তরাধিকারী তিনি। তার প্র-পিতামহ জওহরলাল নেহরু ছিলেন ভারতের প্রথম আর সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী। তার দাদি ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, আর বাবা রাজীব গান্ধী ছিলেন ভারতের সবচেয়ে কমবয়সী প্রধানমন্ত্রী।

২০১৪ সালের নির্বাচনে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ফল করে কংগ্রেস। আর বৃহস্পতিবার রাহুলের নেতৃত্বে দ্বিতীয়বারের মতো শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে দলটির। মোদির বিজেপি যেখানে তিন শতাধিক আসনে জয় পেয়েছে, সেখানে কংগ্রেস জিতেছে মাত্র ৫০টির মতো আসনে। এটাও যদি বড় ধরনের বিপর্যয় বলে না ধরা হয়, তাহলে পারিবারিক দুর্গখ্যাত উত্তর প্রদেশের আমেথিতে নিজের আসনে হেরে যাওয়াটা সন্দেহাতীতভাবে রাহুলের মহাবিপর্যয়। তবে কেরালার ওয়ানগাড়ের অন্য আসনে জয় পেয়েছেন তিনি। ফলে পার্লামেন্টে যাওয়ার সুযোগ ঘটবে তার।

তবে আমেথি ছিল আসলে মর্যাদার লড়াই। এই আসন থেকে দাঁড়িয়ে জয় পেয়েছেন তার বাবা ও মা দুজনেই। গত ১৫ বছর ধরে তিনি নিজেও ছিলেন এই আসনের সংসদ সদস্য। নির্বাচনের আগে আমেথির প্রতিটি পরিবারকে ‘আমার আমেথি পরিবার’ সম্বোধন করে চিঠি পাঠিয়েও ভোট পাননি রাহুল। ব্যালট বাক্সে ভোট পড়েছে অভিনয় থেকে রাজনীতিতে আসা বিজেপি নেত্রী স্মৃতি ইরানির ঘরে।

ভারতের রাজনীতির কেন্দ্রভূমি পরিচিত সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত আমেথি। ভারতের ৫৪৫ আসনের লোকসভার ৮০টি আসনই উত্তর প্রদেশের। সাধারণত বিশ্বাস করা হয় উত্তর প্রদেশে যারাই জেতে তারাই সরকার গঠন করে। রাহুলের প্র-পিতামহ, দাদি, বাবাসহ ভারতের ১৪জন প্রধানমন্ত্রীর আটজনই ছিলেন উত্তর প্রদেশের। এমনকি নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের বাসিন্দা হয়েও ২০১৪ সালের উত্তর প্রদেশ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রিত্বের সূচনা করেছিলেন।

এ বছরের লোকসভা নির্বাচনে কেউ কংগ্রেসের বড় জয় আশা করেনি, তবে অনেকেই ভেবেছিলেন ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে ভালো করবে। সে কারণেই বৃহস্পতিবারের ফলে দলের ভেতরে বাইরের অনেকেই হতবাক হয়েছেন। কংগ্রেস হয়তো পার্লামেন্টে যাবে, তবে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন গান্ধী যুগের অবসান ঘটলো কি? নাকি এতেই দলটির অদৃষ্ট লেখা হয়ে গেলো।

বৃহস্পতিবার দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে মোদিকে অভিনন্দন জানান রাহুল গান্ধী। বলেন, জনগণ তাদের রায় দিয়েছে আর বিজেপিকে বেছে নিয়েছে। কংগ্রেসের পরাজয়ের দায় মেনে নেন তিনি। আমেথিতে তিন লাখ ভোট গণনা বাকি থাকতেই ওই আসনে স্মৃতি ইরানির কাছে পরাজয় মেনে নেন তিনি। বলেন, আমি তাকে অভিনন্দন জানাতে চাই। তিনি জিতেছেন। এটাই গণতন্ত্র আর আমি জনগণের রায়কে শ্রদ্ধা করি।

কংগ্রেসের ফলাফল নিয়ে বিস্তারিত বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কিছু জানাতে অস্বীকার করে রাহুল গান্ধী বলেন, কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে এসব নিয়ে আলোচনা হবে। ওয়ার্কিং কমিটি কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম। জয় পাওয়া ও না-পাওয়া সব কংগ্রেসকর্মীকেই আশা না হারানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আমরা কঠোর পরিশ্রম অব্যাহত রাখবো। অবশেষে আমরা জিতবো’।

তবে রাহুলের দেখানো ভবিষ্যৎ স্বপ্নকে বহুদূরের বলে মনে করেছেন লক্ষ্ণৌর কংগ্রেসকর্মীরা। দলের কয়েক প্রবীণ নেতার পরাজয় দেখার পর স্থানীয় কর্মীরা টিভি সেটে আঠা লাগিয়ে দিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মী বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা খুবই কম। মানুষ আমাদের প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা রাখে না। আমরা যা বলছি তার ওপর ভরসা রাখছে না মানুষ। মোদি তার প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। তারপরও মানুষ তার কথায় ভরসা রেখেছে। এমনকি আমরাও বুঝতে পারছি না কেন!’

কংগ্রেসের শোচনীয় এই ফলের কারণে গান্ধীর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেক বিশ্লেষকই এরইমধ্যে নেতৃত্ব পরিবর্তনের আহ্বান জানাচ্ছেন। তাদের দাবি, দলের সভাপতির পদ থেকে রাহুলের পদত্যাগ। তবে এই ধরনের আহ্বানের সবই এসেছে আগের মতো দলের বাইরে থেকে। আর ধারণা করা হচ্ছে এবারও সেইসব আহ্বান প্রত্যাখ্যাত হবে।

দিল্লিতে গুজব ছড়িয়েছে রাহুল পদত্যাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কংগ্রেস নেতা মনিশঙ্কর আইয়ার বিবিসি হিন্দিকে বলেছেন, কংগ্রেস তার নেতৃ্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না। রাহুল পদত্যাগ করতে চাইলেও কংগ্রেস তার পদত্যাগ গ্রহণ করবে না’। দলের পরাজয়ের কারণ নেতৃত্ব নয় বলে জানান তিনি। মনিশঙ্কর বলেন, ‘পরাজয়ের অন্য কারণ রয়েছে। আমাদের তা নিয়ে কাজ করতে হবে’।

লক্ষ্ণৌতে কংগ্রেসের মুখপাত্র ব্রিজেন্দ্র কুমার সিং সেই কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, গান্ধী পরিবারের দায়িত্ব থাকায় সমস্যা নেই। তার মতে, সমস্যা রয়েছে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নির্বাচনি প্রচারণায় ভুল সিদ্ধান্তে। তিনি বলেন, ‘দলের কাঠামোতে দুর্বলতা রয়েছে। পদবি নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে। মাঠপর্যায়ে প্রচারণা শুরুতে দেরি হয়েছে। এছাড়া ব্যর্থ হলেও উত্তর প্রদেশ ও বিহারে আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে জোট গড়ার প্রচেষ্টাতেও ভুল ছিল’।

কংগ্রেসের অনেক বিশ্লেষকই ব্যক্তিগত পর্যায়ের আলোচনায় স্বীকার করে বলেছেন, ‘ব্র্যান্ড মোদি’র সঙ্গে ব্যক্তিত্বের প্রতিযোগিতায় পরাজিত পক্ষেই থাকবেন রাহুল। ব্রিজেন্দ্র কুমার সিং বলেন, ‘গত নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি পুরণে মোদি ব্যর্থ হলেও তার সরকারের নীতি বিষয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করতে পেরেছেন তিনি।’

মোদির কাছে রাহুলের পরাজয় এবারই প্রথম নয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল করে মাত্র ৪৪টি আসন লাভের পরও বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। তারপরে কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচনে পরাজয়ের পর রাহুলের সভাপতি হওয়া নিয়ে সমালোচনা-বিদ্রূপ হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির দুর্বল পারিবারিক ইতিহাস আর ঐতিহ্যগত পারিবারিক ইতিহাসের তুলনা করে রাহুলের সমালোচনা করেছেন অনেকে। অনেকেই মন্তব্য করেন, মেধার ভিত্তিতে নয়, পারিবারিক সংযোগের কারণে কংগ্রেসের শীর্ষ পদে আসীন হয়েছেন রাহুল।

ব্যক্তিগত আলাপে দলীয় কর্মীরা রাহুলকে সাধারণ মানুষ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। তাদের মতে প্রতিদ্বিন্দ্বীদের তুলনায় তার ধূর্ততা ও ছল-চাতুরির অভাব রয়েছে। সুতরাং এটাকেই তার ব্যর্থতা নাকি গান্ধী ব্র্যান্ডের ব্যর্থতা হিসেবে দেখা যাবে প্রশ্ন থেকে যায় তা নিয়ে।

বিগত কয়েক বছরে গান্ধী পরিবার বেশ খানিকটা প্রভাব হারিয়েছে। বিশেষ করে শহুরে তরুণ ভোটারদের কাছে। কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন তাদের কাছে নেহুরু-ইন্দিরা আমলে নেওয়া নীতির প্রভাব খুব বেশি প্রভাব রাখতে পারছে না। বরং এসব ভোটারদের কাছে ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস সরকারের আমলে দুর্নীতি আর বিতর্কই স্পষ্ট হয়ে আছে। বৃহস্পতিবারের ফলে দেখা গেছে, কংগ্রেসের ওপর ভোটারদের আস্থা এখনও কম। আর রাহুল তার লক্ষ্য দিয়ে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

তবে, পরাজয়ের জন্য কংগ্রেসের কাঠামো কখনোই রাহুল বা তার নামকে দায়ী করেনি। এক কংগ্রেসকর্মীর পরামর্শ, রাহুলের একজন ‘অমিত শাহ’ দরকার। তার ইঙ্গিত বিজেপি সভাপতি যেভাবে কলাকৌশল তৈরি করে মোদিকে প্রথমে গুজরাট আর পরে দিল্লি জয় করে দিয়েছেন সেদিকে। পরাজয়ের জন্য দলের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে হয়তো রাহুলকে দায়ী করবেন না। অতীতের মতোই তারা তাকে সমর্থন করে যাবেন।

গত কয়েক বছরে রাহুলের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে উন্নতিই দেখা গেছে। কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে দলের প্রচারণায় নতুনত্ব এসেছে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও নীতির সমালোচনা করেছেন নিয়মিত। ডিসেম্বরেই তার হাত ধরে রাজস্তান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস জয়ী হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী উত্তর প্রদেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর সবাই ভেবেছিল এবার হয়তো কংগ্রেসের কিছু হবে, লড়াইয়ে ফিরে আসতে পারে দলটি। ভারতের অনেকেই মনে করেন, প্রিয়াঙ্কাই পারবেন সত্যিকার অর্থে কংগ্রেসকে রক্ষা করতে। তবে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ব্যর্থ হয়েছে। এটাকে কংগ্রেসের দলীয় লক্ষ্যের ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হবে। মোদি জনগণকে যেভাবে বুঝতে পেরেছিলেন কংগ্রেস তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

কংগ্রেসের এক রাজ্য নেতা ভিরেন্দ্র মদন বলেন, আমাদের ইশতেহার ছিল সবচেয়ে ভালো। যে নীতি ঘোষণা করা হয়েছে, আমরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তা ছিল একবারে সেরা। কিন্তু আমরা আশা করেছিলাম, ভোটাররা এটাকে সমর্থন দেবেন। কিন্তু তা ঘটেনি।

কংগ্রেস নেতা জানান, কেন্দ্র ও রাজ্য পর্যায়ের নেতারা আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে বৈঠকে বসছেন। তিনি বলেন, আমাদের নিজেদের মূল্যায়নের সময় এখন। ভুল কোথায় হয়েছে, তা বের করা দরকার।

মদন জানান, নির্বাচনের ফল যাই হোক না কেন, নেতাদের প্রতি দলের আস্থা অবিচল থাকবে। তিনি বলেন, ‘শুধু রাহুল নন, আরও অনেকেই হেরেছেন। অনেক নেতাই জিততে পারেননি। নির্বাচন আসে ও যায়। আপনিও কোথাও জিততে পারেন আর কোথাও হারেন। মনে আছে ১৯৮৪ সালের কথা, যখন বিজেপি মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল? তারা কি ফিরে আসেনি?’ তারাও একদিন ঘুরে দাঁড়াবেন বলেও তিনি দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

সম্পর্কিত পোস্ট

এসএসসি পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ উপহার দিলো ছাত্রদল

banglarmukh official

আইন-বিধি মেনে কাজের গতি বাড়ানোর তাগিদ

banglarmukh official

মাগুরায় ধর্ষণের শিকার সেই শিশু মারা গেছে

banglarmukh official

জাতিসংঘ মহাসচিব ঢাকায়

banglarmukh official

দিল্লির ঘরে ঘরে জ্বর!

banglarmukh official

বরিশালে দুর্ঘটনায় নিহত ২

banglarmukh official