সারা বিশ্বে কোভিড ১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই অবস্থায় দ্রুত কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে দ্রুত ভাইরাস নির্ণয়ের নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি, অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আবিষ্কার এবং উৎপাদনও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা এই সমস্যা সমাধানের জন্য সম্মিলিতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে একদল বিজ্ঞানী বায়োইনফরমেটিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিচ্ছেন। তাঁরা চেষ্টা করছেন, বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে ভ্যাকসিন কিংবা ভাইরাস শনাক্তের নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি আবিষ্কারের বিষয়টি ত্বরান্বিত করার।
যেকোনো অ্যান্টিভাইরাল প্রতিষেধক অথবা ভ্যাকসিন তৈরির প্রথম ধাপ হলো ভাইরাসটিকে ভালোভাবে চেনা। এর গঠন এবং আচরণ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করা। কোভিড ১৯-এর জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV 2-এর গঠন সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পেরেছি। এ ছাড়া ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স প্রকাশিত হয়েছে। ফলে উন্মুক্ত হয়েছে ভাইরাসটির গঠন এবং মানবদেহে এর সংক্রমণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে গবেষণার পথ। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে প্রচলিত পদ্ধতিতে SARS-CoV-2 এর কার্যকরী প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ পুরো প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রথমত, এটি ভাইরাসের গঠন এবং আচরণ বুঝে ভ্যাকসিনের জন্য উপযোগী প্রোটিন খুঁজে বের করতে সাহায্য করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভাইরাস প্রোটিন এবং ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত হওয়া অ্যান্টিভাইরাল প্রতিষেধকের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে কার্যকরী প্রতিষেধক সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে।
ভ্যাকসিন কেন প্রয়োজন?
কোভিড–১৯ রোগ সৃষ্টি করা ভাইরাস SARS-CoV 2 প্রোটিন আবরণে আবৃত একটি আরএনএ ভাইরাস। এর প্রোটিন আবরণের উপরিভাগে স্পাইক নামে একধরনের গ্লাইকোপ্রোটিন থাকে, যা এদেরকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে সংক্রমণ করতে সাহায্য করে। মানুষের শরীরে প্রবেশের পর এরা শ্বসনতন্ত্রের কোষে থাকা একধরনের রিসেপ্টর প্রোটিনের সঙ্গে স্পাইকের সাহায্যে সংযোগ স্থাপন করে। পরে কোষের ভেতরে ঢুকে বংশবিস্তার করতে থাকে। অন্যদিকে সংক্রমণের একপর্যায়ে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা ভাইরাসটিকে শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হিসেবে শনাক্ত করে এবং একে নিষ্ক্রিয় করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করতে থাকে। অ্যান্টিবডি হলো একধরনের প্রোটিন, যা আমাদের শরীরকে রোগ–জীবাণুর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। মজার ব্যাপার হলো, একবার কোনো জীবাণু আমাদের শরীরে রোগ সৃষ্টি করলে, ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরির যে নির্দেশনা, তা আমাদের শরীর মনে রাখতে পারে। তাই একই জীবাণু যদি আবার আক্রমণ করে, আমাদের শরীর খুব দ্রুত অ্যান্টিবডি তৈরি করে তাকে রুখে দিতে পারে।
SARS-CoV 2 যেহেতু সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাইরাস, আমাদের শরীর এর বিরুদ্ধে দ্রুত অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে না। কিন্তু আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে যদি আগে থেকেই এই ভাইরাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়, অর্থাৎ ভাইরাসটির যেসব অংশ সংক্রমণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে, সেসব অংশের সঙ্গে পরিচিত করা যায়, তাহলে আমাদের সংক্রমণের পর খুব দ্রুত এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। ঠিক এই কাজ করতেই আমাদের ভ্যাকসিন প্রয়োজন।
SARS-CoV 2 ভাইরাসের গঠন, স্পাইক প্রোটিনের সাথে রিসেপ্টর প্রোটিন এবং অ্যান্টিবডির সংযোগ তৈরির প্রক্রিয়া। ছবি: Mousavizadeh et al. 2020.
SARS-CoV 2 ভাইরাসের গঠন, স্পাইক প্রোটিনের সাথে রিসেপ্টর প্রোটিন এবং অ্যান্টিবডির সংযোগ তৈরির প্রক্রিয়া। ছবি: Mousavizadeh et al. 2020.
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরির কৌশল
আগেই বলেছি SARS-CoV 2-এর প্রোটিন আবরণ বা এনভেলপে থাকা স্পাইক প্রোটিনের সাহায্যে মানুষের শ্বসনতন্ত্রের কোষে প্রবেশ করে। তাই এই স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে আমাদের শরীরে থাকা রিসেপ্টরের সংযোগ যদি বন্ধ করা যায়, তাহলে কোষের ভেতরে ভাইরাসের প্রবেশ এবং বংশবিস্তার প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। আর এই সংযোগ বন্ধ করার অন্যতম উপায় হলো ভাইরাসটি রিসেপ্টর প্রোটিনের সংস্পর্শে আসার আগেই উপযুক্ত অ্যান্টিবডি তৈরি করে স্পাইক প্রোটিনকে আটকে ফেলা এবং পরে নিষ্ক্রিয় করা। আমাদের শরীর এই অ্যান্টিবডি তৈরির কাজটি যেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় করতে পারে, সে জন্য তাকে স্পাইক প্রোটিন বা এর অংশবিশেষের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় করাতে হবে। একই সঙ্গে পরিচয় করানোর প্রক্রিয়াটি এমন হতে হবে, যাতে আমাদের শরীরে এর মাধ্যমে অন্য কোনো রোগ বা মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা না দেয়। এই কাজ সফলভাবে করার জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভ্যাকসিনের ডিজাইন করছেন। এর মধ্যে যে পদ্ধতিটি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে তা হলো, এমআরএনএভিত্তিক ভ্যাকসিন। এই পদ্ধতি অনুযায়ী টার্গেট প্রোটিন (এক্ষেত্রে স্পাইক প্রোটিন) বা এর অংশবিশেষ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জিনোম লিপিড ন্যানোপার্টিকেলের সাহায্যে মানুষের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হবে। প্রোটিন তৈরি করার জন্য যে সিস্টেম আছে মানুষের শরীরে, তা ভ্যাকসিনের সঙ্গে পাঠানো জিনোম থেকে প্রোটিন তৈরি করবে এবং একই সঙ্গে ওই প্রোটিনের বিপরীতে অ্যান্টিবডিও তৈরি করবে। অন্যান্য পদ্ধতির মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হলো, ভাইরাল ভেক্টরভিত্তিক ভ্যাকসিন। এ ক্ষেত্রে টার্গেট প্রোটিনকে ক্ষতিকারক নয়, এমন কোনো বাহক ভাইরাসের সাহায্যে মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো হবে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা টার্গেট প্রোটিনকে চিহ্নিত করে এর বিপরীতে কার্যকরী অ্যান্টিবডি তৈরি করবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সাহায্য করছে
সাধারণত অ্যান্টিবডি যখন কোনো জীবাণুকে আক্রমণ করে, তখন জীবাণুর একটি বিশেষ অংশকে সে প্রথমে চিহ্নিত করে। তারপর এর সঙ্গে আটকে থেকে পুরো জীবাণুটিকে নিষ্ক্রিয় করার প্রক্রিয়া শুরু করে। জীবাণুর যে ক্ষুদ্র অংশ সরাসরি অ্যান্টিবডির সঙ্গে আটকে থাকে, তাকে বলা হয় এপিটোপ। প্রশ্ন হলো, SARS-CoV 2 ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই এপিটোপ হিসেবে কাজ করা ক্ষুদ্র প্রোটিন বা পেপটাইড আসলে কোনগুল