‘জসিম মিয়া ফাইল দাও। লগে ৪শ টাহাও দাও। আচ্ছা তোমারে না কাইল কইলাম নথিগুলা দিয়া আইতে। টাকা নিয়া চিন্তা করো ক্যা মিয়া; টাকা দিবে ভদ্দরলোকেরা।’ কথাগুলো বলছিলেন বরিশাল সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তার চেয়ারে বসা জাহাঙ্গীর হোসেন। সামনে দাঁড়ানো একলোক একটি ফাইল এগিয়ে দিলো। সাথে ৪০০ টাকা। তার পিছনে দাঁড়ানো ষাটোর্ধ জনৈক লোক ফাইলের সাথে সাথে ‘জসিম মিয়া’কে ঠেলে সামনে এসে দাঁড়ায়। জাহাঙ্গীর হোসেন হাতের তলায় রাখা রেজিস্টার খাতা খুলে সাক্ষর ও টিপসই রাখেন।
জাহাঙ্গীর হোসেন যে চেয়ারে বসা তার ঠিক বিপরীতে এজলাসের চেয়ারে বসা বরিশাল সদর উপজেলা সাব-রেজিস্টার রফিকুল ইসলাম। তিনি মন দিয়ে তার কাজ করছেন। ১৯ জুন দুপুর দুইটায় এমন দৃশ্য ছিল বরিশাল সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের। কথা হয়, জসিম মিয়ার সাথে। তিনি লেনদেনকৃত টাকার বিষয়ে কথা বলতে রাজি নন। শেষে জাহাঙ্গীর হোসেনের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি সাব-রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। কথাছলেই বলেন, রেজিস্ট্র অফিস এখন আগের মত নাই। এখন পিওনও মেট্রিক পাস। আগে অনুমতি নেন। পরে কথা। জানতে চাওয়া হয়, সে কোন পদে চাকরী করেন-জবাবে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমি এমএলএসএস।
গল্পের মত মনে হলেও এমন দৃশ্য স্বাভাবিক বরিশাল সদর সাব-রেজিস্ট্র অফিসে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অফিসের বড় বড় কাজ অনায়াসে সমাধান করে ফেলেন এমএলএসএস জাহাঙ্গীর হোসেন। আর তাই তার চেয়ারখানাও সাব-রেজিস্ট্রারের সামনাসামনি। জংাহাঙ্গীর হোসেনের দুইপাশে দু’জন নকলনবিশ বসে খোশ-গল্পে মশগুল। শুধুমাত্র গতকালের চিত্র এটি নয়; প্রত্যেকদিনের চিত্র এমন। রেজিস্ট্রি অফিসে আসা সেবাপ্রত্যাশীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, সদরের ভূমি সংক্রান্ত নথিপত্রের অধিকাংশ কাজ করে থাকেন জাহাঙ্গীর হোসেন।
তার জন্য অনেক সহজে সেবাও পেয়ে থাকেন লোকজন। বিনিময়ে দিতে হয় নগদ টাকা। বিষয়টি অস্বীকার করেননি জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি জানান, মানুষের কাজ করে দেই। খুশি হয়ে যা দেয় তাতেই আমি খুশি। কিন্তু একজন এমএলএসএস হয়ে অফিসের নথিপত্রের কাজ করার দায়িত্ব কি আপনার-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বলেন, স্যার (সদর সাব-রেজিস্ট্রার) আমারে এইখানে কাজ করতে বলছে। আমি করি। কাজের বিনিময়ে যে ঘুষ নিচ্ছেন সেটাও কি সাবরেজিস্ট্রার নিতে বলছেন?-এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর হোসেন চেয়ার ছেড়ে উঠে যান।
পরক্ষণেই দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাবুল হোসেনের নেতৃত্বে ১৫/২০ জন এসে ঘিরে ধরেন প্রতিবেদককে। বাবুল হোসেন জানতে চান, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সাংবাদিকদের কোন কাজ নেই। বেড়িয়ে যান। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হয় সাব-রেজিস্ট্রার রফিকুল ইসলামের সাথে।
তিনি জানান, কাজের চাপ বেশি হওয়ায় জাহাঙ্গীর হোসেনকে ওই চেয়ারে বসে কাজ করতে বলা হয়েছে। ঘুষ গ্রহণের বিষয়ে কোন কথা না বললেও এই কর্মকর্তা জানান, প্রত্যেক অফিসেই ‘টুকটাক’ নিয়মের বাইরে কাজ হয়। তাই বলে আপনারা যে নেগেটিভ নিউজ করবেন-এটা ঠিক না। এদিকে বাবুল হোসেনের নেতৃত্বে আসা যুবকরা এজলাস কক্ষেই উত্তেজিত হয়ে হৈচৈ শুরু করলে সাব-রেজিস্ট্রার রফিকুল ইসলাম চেয়ার ছেড়ে উঠে যান।