28 C
Dhaka
জুলাই ৭, ২০২৫
Bangla Online News Banglarmukh24.com
অপরাধ জেলার সংবাদ বরিশাল রাজণীতি

বরগুনায় সাগরপথে আসছে ইয়াবা, পেছনে এমপি শম্ভুর ছেলে সুনামের গ্রুপ

অনলাইন ডেস্ক :

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বরগুনা ভয়ংকর মাদক ইয়াবা ট্যাবলেট চোরাচালানের নতুন রুটে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার ঢোকার পর সাগরপথে এখানে চলে আসে। বরগুনা শহর ও গ্রামের সবখানে পাওয়া যায় ইয়াবা। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি দেশব্যাপী আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্তত সাতজন ইয়াবা কারবারে জড়িত বলে জানা গেছে। এই খুনের নেপথ্যে যেসব কারণ রয়েছে, তার মধ্যে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধও অন্যতম। বরগুনা শহরের মাদকের এ গ্যাং গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের দুই সহযোগী মঞ্জুরুল আলম জন ও শাওন তালুকদার। জন পৌর কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র রাইসুল আলম রিপনের ছেলে এবং শাওন সুনাম দেবনাথের স্ত্রীর চাচাতো ভাই।

তরুণ আইনজীবী, ছাত্রলীগ নেতাসহ কিছু প্রভাবশালী তরুণও মাদকে আসক্ত। তারা মাদক বিক্রিতেও সহায়তা করে। অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পাথরঘাটার মাছপট্টি, তালতলীর শুভসন্ধ্যা ও টেংরাগিরিচর হয়ে ইয়াবার বড় চালান ঢুকছে বরগুনায়। এসব চালান হাতবদল হয়ে সড়ক ও নৌপথে ঢাকাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাচ্ছে। আর একটি অংশ বরগুনার প্রত্যন্ত অঞ্চল ও শহরে বিক্রি হচ্ছে।

রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের পর ইয়াবার আগ্রাসন এবং প্রভাবশালীদের মদদের বিষয়টি সামনে চলে আসায় বিব্রত স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। তবে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকের বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।

নতুন রুটে সহজলভ্য ইয়াবা, পেছনে প্রভাবশালী
চলতি বছরের ২ এপ্রিল ঢাকায় সপ্তবর্ণা-১ নামের একটি লঞ্চ থেকে আট লাখ ৪৫ হাজার পিস ইয়াবাসহ তুহিন হোসেন, সবুজ ও শাহজাহান নামের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। লঞ্চটি বরগুনা-ঢাকা রুটে চলাচল করে। তারা র‌্যাবকে জানায়, ছয়-সাত মাস পর পর পাঁচ-সাত লাখ ইয়াবা ঢাকায় নিয়ে আসে তারা। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার চালান মাছ ধরা ট্রলারে কক্সবাজার থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পটুয়াখালী ও বরগুনায় আসে। এরপর সেখান থেকে লঞ্চে করে বাহক দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়।

ইয়াবা পাচার ও পরিবহনের সঙ্গে বরগুনার ট্রলার মালিকদের একটি অংশও জড়িত বলে জানা গেছে।

স্থানীয় এক মাদকসেবী ও এক ইয়াবা বিক্রেতা জানায়, মাছ ধরার ট্রলারে করে পাথরঘাটার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ইয়াবার চালান আসছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করেন বরগুনা পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঘাটের নিয়ন্ত্রক মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল। একটিমাত্র মাদকের মামলা থাকলেও এ ইয়াবা গডফাদারের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসন অভিযোগের আঙুলই তোলে না। সোহেলের গুদামে যেতে তিন-চারটি গেট পার হতে হয়। আছে সিসিটিভিও। তবে কাউন্সিলর এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘ষড়যন্ত্র করে আমার নাম বলা হচ্ছে।’

বরগুনার মাদক কারবারিদের মধ্যে অন্যতম বেতাগীর আলাউদ্দিন আকাশ। অস্ত্রসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হলেও এখন জামিনে আছে সে। আরেক শীর্ষ কারবারি শহরের খেজুরতলার হাসান। টেকনাফ থেকে ইয়াবা এনে বিক্রি করার কারণে স্থানীয়রা তাকে ডাকে টেকনাফ হাসান নামে। মাইক্রোবাস চালানোর আড়ালে তার প্রধান কারবার ইয়াবা বিক্রি।

বরগুনা সদর উপজেলা শাখা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মুরাদুজ্জামান টিপন আগে শহরের এই মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করতেন। এখন তিনি কিছুটা কোণঠাসা। মাদক কারবারিদের মধ্যে আরো কয়েকজনের নাম জানা গেছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলাও আছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, সম্প্রতি বুড়িরচর ইউনিয়নের লবণগোলা গ্রামে (নিহত রিফাতের বাড়ির কাছে) আরিফ নামের এক ইয়াবা কারবারিকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পুলিশের হেফাজতে অসুস্থ হয়ে মারা যায় আরিফ। ঘটনার পর মাস না পেরোতেই পুলিশ ফের অভিযান চালিয়ে শতাধিক পিস ইয়াবাসহ আরিফের মা ও ভগ্নিপতিকে গ্রেপ্তার করে। শহরের বাইরেও এমন বেশ কিছু ইয়াবা কারবারি পরিবার তৈরি হয়েছে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।

পেছনে সুনামের সিন্ডিকেট
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরগুনা শহরের কলেজ রোড, ধানসিঁড়ি রোড, উকিলপট্টির একটি কার্যালয়ের পাশে মাদক সহজেই মেলে। বরগুনা সরকারি কলেজের ভেতরে ও পাশে রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড চক্র ইয়াবা বিক্রি করত। শহরের সদর রোডের উকিলপট্টির দুজন প্রভাবশালী তরুণ উকিল ও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হায়দারও আসক্ত বলে জানায় স্থানীয় লোকজন। তানভীরের ফেনসিডিল সেবনের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ কাছে এসেছে। কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানায়, সুনামের সহযোগীদের প্রত্যক্ষ মদদ থাকায় উঠতি ইয়াবা কারবারিদের কেউ কিছু বলতে সাহস পেত না। তাদের বক্তব্যের প্রমাণ দিয়ে এক তরুণ জানায়, নয়নের বাঁ হাতে কবজির নিচে ট্যাটু আঁকা ছিল। অন্য আসামি রিফাত ফরাজী ও সাগরের হাতে একই ট্যাটু দেখা গেছে। একই ট্যাটু আছে শাওনের হাতে। গ্যাং গ্রুপের সঙ্গে সুনাম, জন ও শাওনের বেশ কিছু ছবিও এসেছে  হাতে।

জেলা আওয়ামী লীগের নেতা সুবল তালুকদারের ছেলে ও এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথের শ্যালক শাওন তালুকদার সুনামের ডান হাত বলে পরিচিত। একটি মাদকের মামলাও নেই তাঁর বিরুদ্ধে। করেন না মাদক সেবনও। তবে কলকাঠির নিয়ন্ত্রক তিনিই। শহরে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন শাওন। কিছুদিন পর পর বিদেশ ভ্রমণ করেন। তাঁর আয়ের উৎস মাদক ও জুয়ার আসরের টাকা। শাওন জেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক। দুস্থ খেলোয়াড়দের কল্যাণের নামে সপ্তাহে তিন দিন হাউজি খেলা চালু করে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা। শাওনের চাচাতো ভাই অভিজিৎ তালুকদার ওরফে অভি। তিনি শাওন ও সুনামের সহযোগিতায় কলেজ রোড এলাকার মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন। কখনো গ্রেপ্তার না হলেও তাঁর বিরুদ্ধে মাদক মামলা আছে। শাওনের ফুফাতো ভাই তুষারের বিরুদ্ধেও আছে মামলা। সম্প্রতি তিনি জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।

কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র রাইসুল আলম রিপনের ছেলে জনের বিরুদ্ধে মাদকের কোনো মামলা নেই। পৌর মার্কেটের তৃতীয় তলায় বসে ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসার আড়ালে মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। সুনাম দেবনাথের বাঁ হাত বলে পরিচিত এই জন রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের পর অফিস বন্ধ করে গাঢাকা দিয়ে চলছেন।

সুনাম ও শাওন সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ সদস্য টাক রাসেলের বিরুদ্ধে মাদকের মামলা আছে। তাঁদের ঘনিষ্ঠ আরেকজন ব্রাঞ্চ রোডের মাওলা মীরের ছেলে অয়ন মীর প্রায় দুই বছর ধরে এলাকাছাড়া। আমতলীতে দেড় হাজার বোতলের একটি ফেনসিডিল চালান ধরা পড়লে অয়নের নাম উঠে আসে।

‘ক্লিন ইমেজের’ আরেক মাদক কারবারি সাথিক রুবেল। সুনামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এই সাথিকের বিরুদ্ধেও মাদক মামলা নেই। তিনি নিজে মাদক সেবনও করেন না। সাথিকের বাবা একজন মাছ বিক্রেতা হলেও তাঁর জীবনযাপন বিলাসী। শহরের মাদক কারবারিদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও ছবি আছে।

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে কয়েকবার ফোন করলেও শাওন তালুকদার ও মঞ্জুরুল আলম জন ফোন ধরেননি। সুনাম দেবনাথও গতকাল ফোন কেটে দেন। তবে তিনি আগে বলেছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদের বদনাম করতে মাদকে সংশ্লিষ্টতার কথা ছড়াচ্ছে।

রিফাত শরীফ খুনের পেছনে যেভাবে ইয়াবা

বরগুনা থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন জানান, নয়নের নামে আটটি ও রিফাত ফরাজীর নামে চারটি মামলা রয়েছে। এর বেশির ভাগই মাদকের মামলা। রিফাত শরীফের নামেও মাদকের দুটি মামলা রয়েছে। একটিতে তাঁর সঙ্গে রিফাত ফরাজীও আসামি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক ফরহাদ হোসেন বলেন, নয়ন, রিফাত ফরাজী ছাড়াও তাঁদের খাতায় মুসার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা আছে।

রিফাত শরীফ ও নয়নের ঘনিষ্ঠ ইয়াবাসেবী এক তরুণ বলে, ‘আগে নয়ন খুচরা বিক্রেতা ছিল। তাদের নিয়ন্ত্রণ করত জনসহ সুনামের ঘনিষ্ঠরা। একপর্যায়ে নয়ন বড় ইয়াবার গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ে। এক বছর ধরে সে আলাদাভাবে ইয়াবা বিক্রি করে। ওই সময়ই তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়।’ হত্যাকাণ্ডের পেছনে মাদক কারবার নিয়ে বিরোধ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিচয় প্রকাশ না করে ওই তরুণ বলে, ‘রিফাত শরীফসহ অন্যরা খুচরা ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রি করত। তারা সেবনও করত। গ্রুপ ও পারসোনাল বিরোধের কারণে রিফাত নয়নের থেকে আলাদা হয়ে যায়। তবে জনের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ থাকে রিফাত। নয়ন দূরে সরে যায়। রিফাতকে গ্রেপ্তারের দৃশ্য ভিডিও করে ফেসবুকে দেয় নয়ন। রিফাত জেল থেকে বের হয়ে নয়ন ও রিফাত ফরাজীকে হুমকি দেয়। এরপর সে জন ও শাওনের সহায়তা নিয়ে দাদার (সুনাম) সুপারিশে পুলিশ দিয়ে নয়নকে ধরিয়ে দিতে চায়। নয়ন না থাকলে মার্কেটটা (ইয়াবার বাজার) ওদের দখলে চলে যাবে। এটাই টার্গেট ছিল। বুঝতে পেরে নয়ন ও তার সহযোগীরা রিফাত শরীফকে টার্গেট করে। ওই সময় দুই সহোদর রিফাত ও রিশান ফরাজীর সঙ্গে এবং হেলালের মোবাইল নিয়ে রিফাত শরীফের সঙ্গে ঝগড়ার সুযোগ পায় নয়ন।’ ওই তরুণের ভাষ্য মতে, নয়ন, নিহত রিফাত শরীফ, মুসা, রিফাত ফরাজী, রাব্বী আকন, অলি ও চন্দন ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এরা ছাড়া কয়েকজন আসামিও ইয়াবায় আসক্ত।

সম্পর্কিত পোস্ট

বরিশালে যুবলীগ কর্মীর তাণ্ডব: মা-মেয়েকে কুপিয়ে জখম

banglarmukh official

সাতলায় বিএনপির সভাপতি-সম্পাদকের বিরুদ্ধে আ’লীগ নেতা মিজানকে অর্থের বিনিময়ে দলীয় সনদপত্র প্রদান করার অভিযোগ

banglarmukh official

তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রাম পুলিশের বসত ঘরে ভাংচুর

banglarmukh official

এসএসসি পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ উপহার দিলো ছাত্রদল

banglarmukh official

মাগুরায় ধর্ষণের শিকার সেই শিশু মারা গেছে

banglarmukh official

শিশু আছিয়ার জানাজায় অংশ নিতে মাগুরায় মামুনুল-হাসনাত-সারজিস

banglarmukh official