28 C
Dhaka
জুলাই ৬, ২০২৫
Bangla Online News Banglarmukh24.com
অপরাধ জেলার সংবাদ বরিশাল রাজণীতি

রিফাত হত্যা, আওয়ামী লীগের বিভক্তির কারণেই সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা

বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। দুই যুগের বেশি সময় ধরে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। স্ত্রী মাধবী দেবনাথ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁদের একমাত্র ছেলে সুনাম দেবনাথ জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক। ছেলের শ্বশুর নন্দ তালুকদার জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। আর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তাঁর ভায়রা সিদ্দিকুর রহমান। দলীয় পদে শম্ভু পরিবারের সদস্যদের এই তালিকাই বলে দেয় বরগুনার রাজনীতি এখন পরিবারটির কবজায়। তাঁদের কবজা থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ‘মুক্ত’ করতে দলের অন্য নেতারা শম্ভুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। এই কারণে বরগুনা আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত। সেই বিভক্তির কারণেই সন্ত্রাসী আর অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে। তারা দুই পক্ষের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সহযোগিতায় অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে, প্রকাশ্যে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রিফাত শরীফ খুনের প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ডের নেতৃত্বে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীরা অপকর্ম করত। তাদের মধ্যে নয়ন পরোক্ষভাবে এমপিপুত্রের মদদপুষ্ট। পাশাপাশি পুলিশের সঙ্গেও তার ছিল সখ্য। নিজেকে পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচয় দিত নয়ন। রিফাত ও রিশান আওয়ামী লীগের অন্য অংশের নেতৃত্বে থাকা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের আত্মীয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছে, আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সঙ্গে নয়ন-রিশানদের প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে যোগাযোগ থাকায় তারা অপরাধ করে সহজেই পার পেয়ে যেত। এভাবেই তারা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ফলে কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে তারা শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

এ প্রসঙ্গে সচেতন নাগরিক কমিটি, ঝালকাঠি শাখার সহসভাপতি মনির হোসেন কামাল বলেন, ‘রাজনৈতিক বিভক্তির সুযোগ নিয়ে নয়ন বাহিনী একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছিল। যখনই তারা পুলিশ প্রশাসনের হাতে ধরা পড়েছে, তখনই রাজনৈতিক সহযোগিতায় খুব অল্প সময়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসেছে। আবার নতুন করে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এভাবেই একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে অপরাধীদের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। তাতেই অপরাধীরা বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। বরগুনার ঘটনাটি ঠিক সেভাবেই ঘটেছে।’

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিরোধ এবং অপরাধীরা এর সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের বরগুনা জেলা শাখার সভাপতি জুবায়ের আদনান অনিক বলেন, ‘কমিটি গঠনের সময় সুনাম দেবনাথ পাল্টা একটি কমিটির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যাঁকে সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন, তিনি ছিলেন চিহ্নিত মাদকসেবী। ফলে আমাদের কমিটি অনুমোদন পায়। কমিটির পরও সুনামের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যাঁরা ওঠাবসা করত, তাদের বেশির ভাগই মাদকসেবী ছিল। সময়ের ব্যবধানে দেখেছি, সুনামও মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’

সুনামের মাদক কারবারের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ করেছেন জানিয়ে এই ছাত্রলীগ নেতা বলেন, কলেজ পড়ুয়া নেতাকর্মীরাও সুনামের কাছে ঘেঁষত না। কর্মী না থাকায় তাঁর পাশে জায়গা করে নিয়েছে মাদকসেবীরা।

জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মশিউর রহমান সিহাব বলেন, ‘দলীয় ফোরামে এমপি শম্ভুর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছি। তাঁর পুত্র সুনাম দেবনাথের মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণের সমালোচনা করেছি। এ কারণেই শম্ভু পরিবারবিরোধী আওয়ামী লীগের বড় অংশ আমার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তাদের নিয়েই প্রাধানমন্ত্রীর কাছে এমপির দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেছিলাম। তখন শম্ভু জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। একই সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীশূন্য হয়ে পড়েন। দুর্নীতির কারণে তাঁকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করা হয়।’ তিনি দাবি করেন, মূলত দল ভারী করার জন্য তখন শম্ভুর ছেলে শহরের চিহ্নিত মাদক কারবারিদের দলে টানেন। তাদের নিয়ে শহর দাবড়িয়ে বেড়িয়েছিলেন সুনাম, যারা রিফাতের মতো একটি ছেলেকে নির্মমভাবে খুন করেছে।

রিফাত খুনের ঘটনায় আওয়ামী লীগের ইমেজ দেশবাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ—এমন মন্তব্য করেছেন সিহাব। কথিত গডফাদারের নির্দেশে তিনি হামলার শিকার হয়েছেন দাবি করে বলেন, ‘আমরা রিফাত হত্যাকারী সন্ত্রাসীদের ফাঁসি চাচ্ছি। একই সঙ্গে গডফাদারকেও আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি।’

বরগুনা জেলা যুবলীগের সভাপতি কামরুল আহসান মহারাজ বলেন, ‘২০১৫ সালের পৌরসভা নির্বাচনে আমাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। তখন এমপি শম্ভু প্রকাশ্যে নৌকার বিরোধিতা করেছিলেন। শম্ভু শাহদাত হোসেনের মতো একজন ঠিকাদারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে নৌকা ডুবিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, এমপির নির্দেশে মাদক কারবারিরা আমার ওপর হামলা চালিয়েছিল। তাদেরই নির্দেশে দলীয় কর্মীদের গুলিও করা হয়েছিল।’ তিনি আরো বলেন, ‘মূলত বরগুনা পৌরসভা নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা শম্ভুকে বয়কট করে। তখন থেকেই শম্ভুর আশপাশে তাঁর ছেলের মাধ্যমে মাদকসেবী আর সন্ত্রাসীরা ভিড় করে। ওই সন্ত্রাসীরাই শহরে সন্ধ্যার পর মোটরসাইকেল মহড়া দিত। মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করত। মাদক ছড়িয়ে দিত।’

মহারাজ দাবি করেন, দু-একটি ঘটনায় মামলা হলে গ্রেপ্তারকৃতরা তদবিরের জোরে অল্প দিনেই জেল থেকে বেরিয়ে আসত। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘নয়ন বন্ডের যারা জামিন করিয়েছিলেন, তাঁরা শম্ভুর খুব কাছের লোক।’

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, ‘এমপিপুত্র যখন কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তখন শুধু দলীয় নেতাকর্মী নন, প্রশাসনের বিরোধিতাও কাজে আসে না।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘জেলা ছাত্রলীগের ব্যানারে গত বছর সংবাদ সম্মেলনে মাদক কারবারি নয়ন বন্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছিল। তখন সংবাদ সম্মেলনে মাদক কারবারিদের গডফাদার এমপিপুত্রের ব্যাপারে অনেক তথ্য দেওয়া হয়। ওই ঘটনার পর পুলিশ নয়ন কিংবা তার গডফাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। আমরাও প্রতিরোধ করতে পারিনি রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে। রাজনৈতিক বিরোধের কারণেই নয়নরা দিন দিন ক্ষমতাধর হয়েছে।’ তিনি দাবি করেন, যারা মাদক কারবারিদের প্রশ্রয় দিয়েছে, তারাই প্রতিপক্ষকে দাবাতে তাদের ব্যবহার করেছে।

সুনাম দেবনাথ বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমার বাবার বিরুদ্ধে কতিপয় নেতা জোট বেঁধেছিলেন। তাঁরা দলীয় নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাবার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছিলেন। এমনকি আমার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের হাতে গোনা কয়েকজন মাদকের ভুয়া অভিযোগ তুলেছিল। যাতে আমার বাবা মনোনয়ন বঞ্চিত হন। কিন্তু তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়। আমার বাবা বিপুল ভোটে আবারও নির্বাচিত হন। সেই গ্রুপটিই আবার আমার পরিবারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘রিফাত ও রিশানের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক নেই। আমি রিফাত হত্যার বিচার চাইছি। একই সঙ্গে রিফাত ও রিশানের শাস্তি দাবি করছি।’ সুনাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আসামিরা নয়নের নেতৃত্বে অপকর্ম করত। আমাদের অনুসারী দলীয় নেতাকর্মীদের মারার জন্য কে নয়নকে ব্যবহার করত, তা সবারই জানা। মূলত সুনামের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নয়নরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে।’

তবে সুনাম বলছেন, আওয়ামী লীগকর্মী রিফাত শরীফকে হত্যার পর তাঁদের বিরোধী পক্ষ বলছে, মাদক কারবারি নয়ন বন্ডের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। পুলিশের তদন্তেই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে।

সুনাম আরো বলেন, ‘জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দুই আত্মীয় খুনের সঙ্গে জড়িত। তারাও চিহ্নিত মাদক কারবারি। মূলত নিজেদের অপরাধ ঢাকতেই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেছে।’ দেলোয়ারের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাধিকবার দলীয় মনোনয়ন চেয়ে দেলোয়ার পাননি। সেই থেকেই আমাদের পরিবারের বিরোধিতা করে আসছেন তিনি। এটা নতুন কোনো বিষয় নয়।’

সম্পর্কিত পোস্ট

বরিশালে যুবলীগ কর্মীর তাণ্ডব: মা-মেয়েকে কুপিয়ে জখম

banglarmukh official

সাতলায় বিএনপির সভাপতি-সম্পাদকের বিরুদ্ধে আ’লীগ নেতা মিজানকে অর্থের বিনিময়ে দলীয় সনদপত্র প্রদান করার অভিযোগ

banglarmukh official

তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রাম পুলিশের বসত ঘরে ভাংচুর

banglarmukh official

এসএসসি পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ উপহার দিলো ছাত্রদল

banglarmukh official

মাগুরায় ধর্ষণের শিকার সেই শিশু মারা গেছে

banglarmukh official

শিশু আছিয়ার জানাজায় অংশ নিতে মাগুরায় মামুনুল-হাসনাত-সারজিস

banglarmukh official