মানুষের অতীত অভিজ্ঞতা শুভ নয়। মাইগ্রেশন, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য কারণে তাকে শিখতে হয়েছে পদে পদে। মানুষকে আবিষ্কার করে নিতে হয়েছে তার নিজের চাহিদা। একসময় মানুষ নিতান্ত অসচেতনতায় আগুনের রহস্য উন্মোচন করেছিল। শিল্পবিপ্লবের পরে পরিচিত হলো স্টিম ইঞ্জিনের মতো নতুন অনেক প্রযুক্তির সাথে। বিশ শতকে সামনে আসলো ইন্টারনেট, কম্পিউটার, মোবাইলের মতো যুগ বদলানো আবিষ্কার। কিন্তু এ-ই কি মানবজাতির ভাগ্যে সমাপ্তির গল্প?
অবশ্যই না। ভবিষ্যত বরাবরই কৌতূহল আর দূরদৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত। বর্তমান দিনগুলোতে আমরা এমন সব জীবন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে চলছি, যা আগে কল্পনাও করা যায়নি। বর্তমানের প্রতিটি বছর প্রাচীন কয়েক হাজার বছরের থেকেও বেশি পরিবর্তন একত্রে নিয়ে আসছে। ভবিষ্যতের বিপ্লাবাত্মক আবিষ্কারগুলো নিয়ে হয়তো তেমন কথা হয় না। আমাদের আজকের আয়োজন তাদের নিয়ে। অবশ্যই সম্ভাবনার ওপর ভরসা রেখে।
ব্যক্তিগত রোবট সহকারী
অনেক দিন ধরেই রোবট ব্যবহারের কথা চলছে বিজ্ঞানী মহলে। অনেক ক্ষেত্রে হয়েছেও। চিন্তায় বুঁদ মানুষ জন্ম দিয়েছে সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস ও সিনেমা। আইজ্যাক আসিমভ বা আর্থার সি ক্লার্কের মতো পণ্ডিতেরাও আছেন সেই তালিকায়। সে যাই হোক, গত এক দশক ধরে রোবট বিস্ময়কর দক্ষতার সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে। সোফিয়ার কথা সর্বজন বিদিত। হাল আমলে কয়েকেটি দেশ তো নিরাপত্তা বিভাগে পর্যন্ত রোবটের নিয়োগ দিয়েছে। যদিও ব্যক্তিগত রোবট নির্মাণ চেষ্টায় হালে পানি পাওয়া যাচ্ছিল না।
অ্যামাজোনের Alexa কিংবা অ্যাপলের Siri এই ক্ষেত্রে কয়েক ধাপ সামনে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তাৎর্যপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত এগিয়ে নিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI- কে। সার্বিকভাবেই সরে যাচ্ছে মেঘ। অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে ব্যক্তিগত রোবটের ব্যবহার। আর এই রোবটবিপ্লব মানব সভ্যতাকে নতুন করে বাধ্য করবে নিজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে।
ইমারসিভ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি
ভবিষ্যতের যতগুলো সম্ভাবনা আছে, তার মধ্যে অগ্রগণ্য পুরোপুরি ইমারসিভ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। পারিপার্শ্বিক বাস্তবতাকে ভার্চুয়াল জগতে ফুটিয়ে তুলবে পুরোদমে। সত্যি বলতে বাস্তব এবং অবাস্তবের ধারণায় ফারাক থাকবে না মোটেও। সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির অসহযোগিতার জন্য হয়তো এখনো অতটা এগিয়ে যাওয়া যায়নি। তবে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে ক্রমে সমৃদ্ধ ও পরিণত হওয়া ভার্চুয়াল জীবন নতুন আশ্রয় হিসাবে উপস্থাপিত হচ্ছে।
ইদানীং গেইমের মতো বিষয়গুলোও প্রায় চলে গেছে এর নিয়ন্ত্রণে। মাঝরাতে ঘুরে ফিরে বিনোদন অর্জনের কি দরকার, যদি একই কাজ ঘরে বসে করা যায়?
ক্রাইয়োনিক্স
বয়স যেন সচেতন শত্রুর মতো বেড়ে যায় প্রতিনিয়ত। আর একসময় গ্রাস করে নেয় মৃত্যু। মানব সভ্যতার গোড়া থেকেই মানুষ অমরত্ব খুঁজেছে। গড়ে উঠেছে অজস্র আখ্যান ও অভিযান। ব্যাবিলনীয়ান মহাকাব্য গিলগামেশ থেকেই তার নজির পাওয়া যায়। সেদিন গিলগামেশ অমর হতে ব্যর্থ হয়েছিল। আজকের বিজ্ঞান কিন্তু হতাশ করছে না।
মৃত্যুকে পরাজিত করার অদ্ভুত এক পদ্ধতির কথা বলছেন কেউ কেউ। আমাদের শরীরকে সত্যি সত্যি বরফে জমিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। ঠিক এইখানেই ক্রাইয়োনিক্স—নিজেকে বিজ্ঞান বলে দাবি করে। এমন বিজ্ঞান যেখানে মানুষের লাশকে বরফে রেখে অবিকৃত অবস্থায় রাখা হয়, যেন কোনোদিন তাকে পুনরায় জাগিয়ে তোলা যায়।
অনেক বিজ্ঞানীই একে হাতুড়ে মতবাদ বলে অবজ্ঞা করতে চান। কিন্তু তাতে দমে যাবার পাত্র নয় একটা শ্রেণী। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ক্রাইয়োনিক্স অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট ডেনিস কোয়ালস্কি। তিনি শুধু বলেছিলেন, আমরা গ্যারান্টি দিতে পারি না যে, কাউকে ফিরিয়ে আনতে পারব। তবে এইটা সত্য, যদি আপনাকে পুতে ফেলা হয় কিংবা পুড়িয়ে ফেলা হয়; তবে আর পাওয়া যাবে না।
নেহাৎ অবজ্ঞার হলেও এই হাতুড়ে গবেষকদের চিন্তাই গেইমচেঞ্জার হিসাবে আবির্ভুত হতে পারে। হাজার হাজার দেহ এখন অব্দি বরফে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ইয়েল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিক সময়ে মৃত শূকরের ব্রেইন নিয়ে গবেষণা করে তাকে কাজ করাতে সক্ষম হয়েছেন। আর সেই ফলাফল টনক নড়িয়ে দিয়েছে মানবজাতিকে আরো একধাপ এগিয়ে যাবার জন্য।
এক্সোস্কেলিটন
এক্সোস্কেলিটন কোনোভাবেই নতুন প্রযুক্তি না। সামরিক উদ্দেশ্যে বিস্তর গবেষণা ও অগ্রগতিতে এই প্রযুক্তি চালু আছে ১৯৬০ সালের দিক থেকে। সংজ্ঞাগতভাবে, এক্সোস্কেলিটন বাইরে থেকে নিযুক্ত কৃত্রিম অস্থি বা কঙ্কাল, যা শরীরকে সাহায্য বা সুরক্ষা দিতে ব্যবহৃত হয়।
এক্সোস্কেলিটন কোটি মানুষের জীবনই বদলে দিতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। গবেষকেরা মনে করেন, শিল্পকারখানায় এর দৈনন্দিন ব্যবহার বাড়বে আসছে দিনগুলোতে। বিশেষ করে যেখানে কর্মচারীদের অধিক শক্তির প্রয়োজন হয় এবং কাজটা রোবটের দ্বারা করা সম্ভব না। তারচেয়ে বড় কথা, এক্সোস্কেলিটনেরই একটা বিশেষ প্রকার দেশের বয়স্ক ও অসুস্থদের চলাচলে দেবে নতুন মাত্রা।
The Verge এর প্রতিবেদক সম্প্রতি মোটরনির্মিত এক্সোস্কেলিটনের কথা বলেছেন, যা আবিষ্কার করেছে SuitX। এই এক্সোস্কেলিটন গায়ে জড়ালে একজন প্যারালাইজড ব্যক্তি হাঁটার সক্ষমতা পাবে।
উড়ন্ত গাড়ি
বিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকেই উড়তে সক্ষম গাড়ির কথা শুনিয়ে এলেও তা এখনো লোকদৃষ্টির অগোচরেই রয়েছে। তবে এবার বেশ কিছু ঘোষণায় ধারণা করা হচ্ছে তার খুব দেরি নেই। সম্প্রতি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান Uber দাবি করেছে, শীঘ্রই তাদের এয়ার ট্যাক্সি বহর চালু করার চিন্তা আছে। সেই সাথে নিযুক্ত আছে নানা গবেষণা সংস্থা।
যদি সত্যিই সফল হওয়া যায়, মানব সভ্যতা এক নতুন যুগে প্রবেশ করবে। ছোট আকারের কোয়াডকপ্টার ড্রোনের মতো হলেও খুব শীঘ্রই পাবে স্বাভাবিক আকৃতি ও গতি। সম্প্রতি সময়ে বিভিন্ন মেগাসিটিতে জ্যাম কিংবা নাগরিক ভোগান্তি থেকে কেবল মুক্তি নয়। এই আবিষ্কার গঠন করবে যোগাযোগের নতুন সংজ্ঞা। বিখ্যাত সিনেমা ব্লেড রানারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে।
অটোমোবাইলের আবিষ্কার অনেকটাই বদলে দিয়েছিল আমাদের জীবনযাত্রার মান। গাড়িঘটিত সমস্যাদি থেকে মুক্তির জন্যও আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে সভ্যতা।
হলোগ্রাফি
অন্যান্য প্রযুক্তি ও গবেষণায় বোধ হয় অনেকটা চাপা পড়ে গেছে ত্রিমাত্রিক হলোগ্রামের কথা। একসময় এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। তবে বেশ কিছু দেশ একে নিয়ে কাজ করে চলছে।
ভবিষ্যতে হলোগ্রাফে বিশেষ ধরনের চশমার প্রয়োজন পড়বে না। সেই সাথে স্তরবিহীন থ্রি-ডি হলোগ্রাম হাজার মাইল দূরের কারোসাথে বিরামহীন যোগাযোগে সক্ষম করে দেবে। মনে হবে যেন তারা বসে আছে পাশেই।
কৃত্রিম মধ্যাকর্ষণ
বর্তমান বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান সমস্যা—মহাকাশে আমরা মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। ফলে সম্ভব হয় না অনুকূল পরিবেশ তৈরি। কৃত্রিম মধ্যাকর্ষণ সৃষ্টির সক্ষমতা মহাকাশীয় অনেক ফাঁদ থেকেই বের হয়ে আসার পথ উন্মোচন করে দেবে।
তাত্ত্বিকভাবে বলকে কেন্দ্রীভূত করার মাধ্যমে কৃত্রিম মধ্যাকর্ষণ সৃষ্টি করা সম্ভব। এজন্য দরকার বেশ ভারি পরিমাণে মহাশূন্য দ্রব্যাদি। যেমনটা আর্থার সি ক্লার্কের 2001: A Space Odyssey কিংবা অন্যান্য অনেক সায়েন্স ফিকশনেই দেখা গেছে।
মহাকাশে বসবাস
১৯৭০ সালের দিকে নাসা মহাশূন্যে বসতি নির্মাণের খসড়া ইশতেহার প্রণয়ন করে। প্রক্রিয়ায় বাজেট রাখা হয়েছিল কমবেশি ৩৫ বিলিয়ন ডলার। এই চিন্তাটা পৃথিবীকে কল্পনার অন্যতম উচ্চতায় নিয়ে গেছে। মানুষ নিজেকে ভাবতে শুরু করেছে মহাবিশ্বের একচ্ছত্র নায়ক হিসাবে। এই ক্ষেত্রে অন্তত তিনটা নাম না আনা অপরাধ হবে—বার্নাল স্ফিয়ার, স্ট্যানফোর্ড টোরাস এবং ও’নেইল সিলিন্ডার।
কলোনিগুলো অবস্থিত হবে ল্যাগ্রানজিয়ান পয়েন্টে, যাকে বলা হয় L5। জায়াগাটা চাঁদ, সূর্য এবং পৃথিবী থেকে ভারসম্যপূর্ণ দূরত্বে থাকার কারণে বেশ নিরাপদ। প্রতিটি কলোনিই হবে স্বনির্ভর এবং পর্যাপ্ত কৃষি এলাকা নিয়ে গঠিত।
ও’নেইল সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে এটি হবে ৫ মাইল প্রশস্ত এবং ২০ মাইল লম্বা। তিন টুকরো ভূমি পরস্পর যুক্ত থাকবে। কলোনিগুলো সক্ষম থাকবে নিজের মধ্যাকর্ষণকে নিয়ন্ত্রণ করতে। এই ধরনের মহাকাশীয় ব্যবস্থা আমাদের অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর বাইরেই কেবল নয়; সৌর জগতের বাইরে বসবাস করার স্বপ্ন দেখায়।
ফিউশন শক্তি
জীবাশ্ম জ্বালানী যে হারে আমরা ব্যবহার করছি, তাতে বেশিদিন টিকবে বলে মনে হয় না। প্রায় একই কথা প্রযোজ্য অন্যান্য শক্তির উৎসের জন্য। সেক্ষেত্রে ফিউশন বিক্রিয়ায় উৎপন্ন শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শক্তি ব্যবহারের নির্ভরশীলতায় এমন নাটকীয় পরিবর্তন ভবিষ্যৎ মানব সভ্যতার গতিমুখ নির্ধারণেও সাহায্য করবে।
১৯৫০-এর দশক থেকে ফিউশনের অগ্রগতির জন্য গবেষণা চলছে। যদি তৈরি করা হতো, আমরা এতদিনে প্রভূত শক্তির অধিকারী হতাম। বিজ্ঞানীরা দেখিয়ে দিয়েছেন, মাত্র এক কিলোগ্রাম ডিউটেরিয়াম থেকে যে পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়; তা দিয়ে দশ লাখ বাড়িকে বিদ্যুতের আওতায় আনা সম্ভব। অথচ ওই ডিউটেরিয়াম আসবে পানি থেকে। বিষয়টা কঠিন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের আবিষ্কার এবং সফলতাগুলো ভবিষ্যতের জন্য আশা জাগায়।