31 C
Dhaka
জুলাই ১২, ২০২৫
Bangla Online News Banglarmukh24.com
জাতীয় রাজণীতি

কবিতা খানমের সংবিধান পাঠ

নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন প্রসঙ্গে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘উক্ত বিষয়ে প্রণীত আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করিবেন।’ কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছর এবং সংবিধান প্রণয়নের ৪৬ বছর পরেও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারেননি আমাদের রাষ্ট্রের পরিচালকেরা। করার উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও জানা যায় না।

বর্তমান কে এম নুরুল হুদা কমিশন এবং এর আগের কাজী রকিবউদ্দীনের কমিশন গঠিত হয়েছিল সার্চ কমিটির মাধ্যমে। এর আগের সব কমিশন গঠিত হতো নির্বাহী বিভাগের সুপারিশে। সেদিক থেকে এর এক ধাপ অগ্রগতি হতে পারত, যদি কমিশন তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে সচেষ্ট থাকত। বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য যে প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। সর্বত্র দলীয় রাজনীতি ঢুকে পড়েছে।

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে চার কমিশনার (প্রধান কমিশনারসহ) বনাম এক কমিশনারের যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, তার মূলেও আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অতিমাত্রায় রাজনৈতিকীকরণ। অথচ বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিশন তো বটেই, তারা যেসব প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে কাজ করবে, সেই জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সব সময় রাজনীতির বাইরে রাখা হয়। রাজনীতির বাইরে রাখার অর্থ সরকারি কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পছন্দসই প্রার্থী বা দলকে ভোট দিতে পারবেন না, তা নয়। রাজনীতির রাইরে রাখা মানে তাঁরা যখন পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন, তখন সেখানে শতভাগ পেশাদারি বজায় রাখবেন। তাঁদের বাঁয়ে–ডানে হেলে পড়ার কোনো সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন শুধু একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। তাদের ওপর যে ১০ কোটি মানুষের ভোট আমানত আছে, সেটি তারা কোনোভাবে খেয়ানত করতে দিতে পারে না। প্রতিটি মানুষ যাতে তার ভোটটি পছন্দসই প্রার্থী বা দলকে দিতে পারে, সেই নিশ্চয়তা কমিশনকেই দিতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচন কমিশনার থাকার কোনো অর্থ হয় না। এই দায়িত্বটি এতই মহৎ যে সংবিধান বলে দিয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে ছিলেন, এমন ব্যক্তি ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের যোগ্য হইবেন না।

অন্য কমিশনাররা কেবল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদে নিয়োগের যোগ্য হবেন, অন্য কোনো পদে নন। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের ৪ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।’ এখন নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীরা নিজেরাই বিবেকের কাছে প্রশ্ন করুন, তাঁরা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করছেন বা করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত আছেন।

এই গৌরচন্দ্রিকা দিতে হলো নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক একটি বৈঠক ও তার ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া দেখে। গত সোমবার অনুষ্ঠিত নির্বাচন কমিশনের ওই বৈঠকে কমিশনের অন্যতম সদস্য মাহবুব তালুকদার কিছু প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে আপত্তি জানিয়ে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের কাছে বেরিয়ে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, কমিশনের বৈঠকে তাঁর বাক্স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। তাঁকে ছাড়াই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাসহ চার কমিশনার বৈঠক করেন। পরে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, তাঁদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও নির্বাচন করতে কোনো সমস্যা হবে না।

ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হয়নি। নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম এক দিন পর বললেন, মাহবুব তালুকদার যেসব প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন, তার কোনোটি অপরিপক্ব, কোনোটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি তাঁর কাছে অপরিপক্ব বা অসময়োচিত মনে হয়েছে। যেখানে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নিয়ে তোড়জোড় চলছে, বিদেশি কূটনীতিকেরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইছেন, যেখানে অতীতে সব জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, সেখানে সেই প্রস্তাব অপরিপক্ব হয় কী করে? তাঁর দাবি, মাহবুব তালুকদার সাংবাদিকদের কাছে ব্রিফ করায় ইসির জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার বার্তা গেলেও কমিশন তা মনে করছে না। কমিশনের ঐক্যও নষ্ট হয়নি। সে ক্ষেত্রে কবিতা খানমের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা, তিনি কমিশনের ঐক্য বলতে কী বোঝাচ্ছেন? একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যদি কমিশনের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রশ্ন আসে, তাহলে মাহবুব তালুকদারের প্রস্তাবগুলো আলোচনা করা জরুরি। আর যদি কমিশন ২০১৪ সালের মতো আরেকটি বিতর্কিত, অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চায়, তাহলে তার জন্য কোনো পর্যায়ে নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়েই আলোচনার প্রয়োজন নেই। ভোটের দিন–তারিখ ঠিক করে ফলাফল ঘোষণা করে দিলেই তাদের দায়িত্ব শেষ হবে। আর সে জন্য কোনো কমিশনারেরও প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

যে প্রস্তাবকে কবিতা খানম সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেছেন, এবার আসি সেই প্রসঙ্গে। কমিশনার মাহবুব তালুকদার নাকি জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে নেওয়ার কথা বলে মহা অন্যায় করে ফেলেছেন। যদি তিনি সেটি বলেও থাকেন, তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীরা হরহামেশাই বলে বেড়াচ্ছেন যে নির্বাচনের সময় সরকার রুটিন কাজ করবে। নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। নির্বাচনসংক্রান্ত সব দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপরই ন্যস্ত হবে।

২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে নির্বাচনের সময় যে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন, সেটি নিশ্চয়ই তাঁর (খালেদা জিয়ার) নেতৃত্বে আরেকটি আলাদা সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে নয়; বরং নির্বাচনের সময়ে ওই দুটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যাতে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে। অর্থাৎ নির্বাচনের সময় নির্বাচনী কাজে ওই দুটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশনের আদেশ–নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবেন।

নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম যে সংবিধানের দোহাই দিয়েছেন, এখন দেখা যাক সেই সংবিধানে কী আছে। সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যে রূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেই রূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’ এর অর্থ শুধু ওই দুটি মন্ত্রণালয় নয়, এর বাইরে থাকা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদেরও কমিশন তার এখতিয়ারে নিয়ে আসতে পারবে। আর মাহবুব তালুকদার নিশ্চয়ই তাঁর এবং অন্যান্য কমিশনারের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কাজে ব্যবহারের জন্য স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিয়ে যেতে বলেননি।

কবিতা খানম নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালনের আগে আইন-আদালত নিয়েই কাজ করেছেন। সে ক্ষেত্রে মাহবুব তালুকদারের কথার মর্মার্থ তাঁর অনুধাবন না করার কথা নয়। তারপরও তিনি সংবিধানের দোহাই তুলে ‘বাঙালকে হাইকোর্ট’ দেখালেন। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সুষ্ঠু, অবাধ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন করা। এখন দেখার বিষয় সেই নির্বাচন করার ক্ষেত্রে মাহবুব তালুকদারের প্রস্তাবটি, না কবিতা খানমের সংবিধান পাঠ অন্তরায়?

কবিতা খানম আমাদের সংবিধান শেখাচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের নেতৃত্বাধীন কমিশন যে সম্প্রতি পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের নামে নানা রঙ্গ দেখিয়েছ, সেটি কতটা সংবিধানসম্মত ছিল? সংবিধান তাঁদের ওপর যে গুরুদায়িত্ব দিয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেননি সেটি পালনে তাঁরা সক্ষম। সবশেষে বলতে চাই, জনগণকে সংবিধানের পাঠ শেখানোর আগে সংবিধান নির্বাচন কমিশনারদের ওপর যে গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছে, তারা সেটি পালন করলে দেশ ও জাতি মহাদুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে।

সম্পর্কিত পোস্ট

এসএসসি পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ উপহার দিলো ছাত্রদল

banglarmukh official

আইন-বিধি মেনে কাজের গতি বাড়ানোর তাগিদ

banglarmukh official

আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যার বিচার ৭ দিনের মধ্যে শুরু হবে: আইন উপদেষ্টা

banglarmukh official

শুক্রবার কক্সবাজার যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ও জাতিসংঘ মহাসচিব

banglarmukh official

শিশু আছিয়ার মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক, দ্রুত বিচার নিশ্চিতের নির্দেশ

banglarmukh official

২০২৬ সালেই বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণ করা হবে

banglarmukh official