31 C
Dhaka
মে ১, ২০২৫
Bangla Online News Banglarmukh24.com
আন্তর্জাতিক

১০০ বছর পরও রেশ রয়ে গেছে

অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান’ রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী আর্চ ডিউক ফ্রানজ ফার্দিনান্দ সারায়েভোর রাস্তায় সস্ত্রীক গুপ্তহত্যায় নিহত হয়েছিলেন। ওই ঘটনার সূত্র ধরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল বটে; তবে ঐতিহাসিকেরা সব সময় বলেন, বিশ্বযুদ্ধের মূলে ছিল ইউরোপের জাতিগুলোর অতি জাতীয়তাবাদী লিপ্সা।

আজ শত বছর পরে ইউরোপ তথা বিশ্বজুড়ে সেই জাতীয়তাবাদী লিপ্সা আর উগ্রতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ১১ নভেম্বর প্যারিস শহরের কেন্দ্রস্থল অর্ক দ্য ট্রিউম বা বিজয় তোরণসংলগ্ন শঁজেলিজে সড়কের অনুষ্ঠানে প্রায় ৭০ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা উপস্থিত হয়েছিলেন। সংঘাতের অবসানসংক্রান্ত চুক্তি যা ‘আর্মিস্টিস’ নামে পরিচিত সেই প্রথম মহাযুদ্ধের শত বছর স্মরণ করতেই এই আয়োজন। অনুষ্ঠানে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ পুনরায় পুরোনো জাতীয়তাবাদী শক্তি আবারও বিশ্বজুড়ে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা ডেকে আনছে বলে বিশ্বনেতাদের সতর্ক করেছেন।

শত বছর বা তার একটু আগের ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের জনজীবন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চালিত হলেও মূলত তিনটি বিষয় প্রধান ছিল। প্রথমত, শিল্পবিপ্লব ও সাম্রাজ্যবাদ; দ্বিতীয়ত, ধনতন্ত্রবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ; তৃতীয়ত, উদারপন্থী ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।

সেই সময় ইউরোপের কোনো জাতি বা রাষ্ট্র কে কার সঙ্গে যুদ্ধ-সংঘাতে লিপ্ত হয়নি, তা জানতে বিস্তর ইতিহাস পড়তে হবে। ওই সময় ইউরোপের জাতিতে-জাতিতে যুদ্ধ-সংঘাত হয়েছে উপনিবেশ দখলের স্বার্থে, নিজেদের জাতীয়তাবাদী শক্তিমত্তা ও সাম্রাজ্য বাড়ানোর প্রয়াসে। তবে সব যুদ্ধের ভিত্তিভূমি ছিল অতি জাতীয়তাবাদী চেতনা, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ। ১৯১৪ সালের ১৪ জুন তৎকালীন সার্বিয়া, বর্তমানে বসনিয়া হার্জেগোভিনার রাজধানী সারায়েভোর রাস্তায়, অস্ট্রিয়ার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী আর্চ ডিউক ফ্রানজ ফার্নিনান্দ বসনিয়ার স্বাধীনতাকামী গোপন বিপ্লবী দলের একজন সদস্যের হাতে সস্ত্রীক নিহত হন।

এ ঘটনার পর ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সেনাবাহিনী সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করে। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সাম্রাজ্যের বড় প্রতিবেশী জার্মানিও এ যুদ্ধের পক্ষ নেয়। আর অপরদিকে সার্বিয়ার পক্ষ নিয়েছিল রাশিয়া, ফ্রান্স ও ব্রিটেন। এরপর জার্মানি ১ আগস্ট রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবং ৩ আগস্ট ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে সেদিনই জার্মানি বেলজিয়াম আক্রমণ করে। অন্যদিকে ব্রিটেন ৪ আগস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার বেশ কিছুদিন পর বুলগেরিয়া, তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য জার্মানির পক্ষে যোগ দিয়েছিল, তাদের বলা হতো সেন্ট্রাল পাওয়ারস। অন্যদিকে সার্বিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ ১৮ রাষ্ট্র—তাদের বলা হতো অ্যালাইড পাওয়ারস।

ইউরোপ মহাদেশ ছাড়িয়ে এই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে। সব মিলিয়ে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল ৪০টি রাষ্ট্র। যুদ্ধে নিহত হয় প্রায় দুই কোটি মানুষ। চার বছরব্যাপী এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হয়েছিল ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর। জার্মান ঐতিহাসিক অধ্যাপক আদ্রেয়াস রোড্ডার সম্প্রতি বলেছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও তার মিত্রদের পরাজয়ের রেশ এখনো জার্মানি ও আঞ্চলিক দেশগুলোর রাজনীতিতে রয়েছে।

শত বছর আগের যুদ্ধ ও সহিংসতা ভুলে সাবেক শত্রু আর মিত্ররা প্রায় ৭০ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শত বছর স্মরণ অনুষ্ঠানে প্যারিসে ভবিষ্যতে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। শত বছর আগের সেই হিংসা-হানাহানির পরিস্থিতি যদিও এ মুহূর্তে ইউরোপে নেই; তবু তার কিছু আলামত-উপসর্গ ইদানীং দেখা যাচ্ছে।

প্রথম মহাযুদ্ধের শত বছর স্মরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ নানা দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা। সেই অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের জীবন দেওয়ার পরও পুরোনো জাতীয়তাবাদী ভূত আবার বিশ্বজুড়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং তা বিশ্বের শান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেন, ‘অতি জাতীয়তাবাদী গৌরব ও সামরিক ঔদ্ধত্যই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ডেকে এনেছিল এবং দুটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে।’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত লাখ লাখ অজ্ঞাতপরিচয় সেনার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন হলেও ইউরোপীয় নেতারা প্যারিসে বিশ্বশান্তি ও সাম্যের বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তবে এ সময়ের বিশ্বরাজনীতিতে জাতীয়তাবাদকে সামনে আনার উদ্যোক্তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। সব বিশ্বনেতা প্রথমে বাসে, পরে বৃষ্টিস্নাত আবহাওয়ায় ছাতা মাথায় একসঙ্গে প্যারিসের শঁজেলিজে সড়ক থেকে বিজয় তোরণ পর্যন্ত হেঁটে মূল অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান। ট্রাম্প প্যারিসে পৌঁছানোর আগেই ফ্রান্স ও জার্মানি প্রস্তাবিত ইউরোপীয় সেনাবাহিনী গড়ার পরিকল্পনার সমালোচনা করে ন্যাটো জোটকে অধিক আর্থিক সহযোগিতার আহ্বান জানান। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউরোপীয় সেনাবাহিনী গড়ার বিষয়টি ভালো উদ্যোগ বলে মনে করছেন।

ইউরোপ মহাদেশ দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ করেছে, দুটি যুদ্ধেই সহযোগী হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিগত সময়ে অনেক মহাদেশীয় বিষয়ে ইউরোপকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়েছে। তবে সময় বদলে যাচ্ছে। ইউরোপীয় নেতারা ক্রমেই অর্থনীতি, বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও বিশ্বশান্তির মতো বিষয়গুলোতে নিজেদের ভাবনাকে প্রাধান্য দিতে চাচ্ছেন।

শত বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূলে যে জাতীয়তাবাদী উগ্রতার বীজ ছিল এবং তারই হাত ধরে আরও বলীয়ান হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দরজা খুলে গিয়েছিল। আজ শত বছর পর আবার সেই আলামত প্রবল হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ইতালি সর্বশেষ ব্রাজিল—সর্বত্র উগ্র জাতীয়তাবাদীদের আস্ফালন এখন প্রবল। তবু সৌভাগ্যের কথা, এঁদের রুখতে এমানুয়েল মাখোঁ ও আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মতো নেতারাও এ বিশ্বে রয়েছেন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দিল্লির ঘরে ঘরে জ্বর!

banglarmukh official

পাকিস্তানে ট্রেনে জিম্মি দেড় শতাধিক যাত্রী উদ্ধার, ২৭ সন্ত্রাসী নিহত

banglarmukh official

পাকিস্তানে যাত্রীবাহী ট্রেন হাইজ্যাক, জিম্মি শতাধিক

banglarmukh official

আইসিইউ থেকে পালালেন ‘কোমা’য় থাকা রোগী, হাসপাতালের ভয়ঙ্কর জালিয়াতি ফাঁস

banglarmukh official

গাজা দখলের যে কোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে হবে: তুরস্ক

banglarmukh official

মালয়েশিয়ায় বিনোদন কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশিসহ আটক ৮০

banglarmukh official