সিনিয়র রিপোর্টার/বিপ্লব আহমেদ:
বরিশাল সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দুর্নীতিবাজ স্টেনো টাইপিষ্ট মোঃ সেলিম হোসেনকে ঝালকাঠী সিভিল সার্জন কার্যালয়ে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় গত ৭ নভেম্বর ।
কিন্তু প্রায় এক মাস অতিবাহিত হলেও সেলিম নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেননি। স্বাস্থ্য বিভাগের বরিশালের পরিচালক ডাঃ মাহাবুবুর রহমানও সেলিমের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন। পরিচালকের আদেশ না মেনে, এখনো বরিশাল অবস্থান করছেন সেলিম।
বদলি আদেশে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের কথা উল্লেখ রয়েছে। অথচ বদলি আদেশের এক মাস পেরিয়ে গেলেও তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেননি। বদলি ঠেকাতে তিনি বিভিন্ন দপ্তরে লবিং করছেন। এমনকি আদালতের দ্বারস্থও হয়েছেন। বদলির আদেশ ঠেকাতে গত ১৩ নভেম্বর সেলিম হোসেন পরিচালক বরাবরে লিখিত আবেদন করেন। এতে সেলিম হোসেন উল্লেখ করেন ‘২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল তাকে বরগুনায় বদলি করা হয়।
বদলির আদেশ চ্যালেঞ্জ করে ৫ জুলাই বরিশাল আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। আবেদনের প্রেক্ষিতে বদলি আদেশ স্থগিত করা হয়। ওই বদলির আদেশ স্থগিত রয়েছে বলে দাবী করেন সেলিম হোসেন’। সেলিমের এ ধরনের আবেদন পাওয়ার পরে পরিচালক প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সরকারী আইনজীবীর কাছে মতামত চেয়ে চিঠি প্রেরণ করেন।
পরিচালকের চিঠি পেয়ে সরকারী কৌশলী শামসুন্নাহার মুক্তি, পরিচালক বরাবরে আইনী মতামত প্রদান করেন। এতে বলা হয় ‘ সেলিম হোসেন ৯ বছরে তার আনীত এ.টি ১২/২০০৯ মামলা নিষ্পত্তি করার কোন প্রয়োজন মনে করেননি। এমনকি বদলির কার্যক্রম স্থগিত আদেশও বর্ধিত করেননি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তার কার্য সিদ্ধ হওয়ায় ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিলের বদলির আদেশ ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারী পর্যন্ত স্থগিত করায়, পরবর্তীতে এর ফল দীর্ঘ ৯ বছর পর্যন্ত বদলির আদেশ স্থগিত করায়, পরবর্তীতে তার ফল ৯ বছর পর্যন্ত উপভোগ করেছেন বিধায় উহার অগ্রগতির কোন প্রচেষ্টা করেননি।
২০০৯ সালের ৫ জুলাইয়ের ট্রাইব্যুনালের আদেশ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত বদলির আদেশের কার্যকারিতা ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারী পর্যন্তই স্থগিত ছিল। এমতাবস্থায় সেলিম হোসেনকে ৭ নভেম্বর ঝালকাঠী সিভিল সার্জন অফিসে বদলি করে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে বলা হয়। ওই বদলি আদেশের ফলে কোন বেআইনী কার্যক্রম হয়নি। সুতরাং সেলিম হোসেনকে ঝালকাঠী সিভিল সার্জন অফিসে বদলির আদেশ বহাল রাখতে, আইনি কোন সমস্যা নেই”।
এ ধরনের মতামত পেয়ে পরিচালক মোঃ মাহাবুবুর রহমান, ১৮ নভেম্বর সেলিম হোসেনকে চিঠি দেন। এতে পরিচালক উল্লেখ করেন ‘সরকারী কৌশুলী, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের মতামত অনুযায়ী বদলি আদেশ বাতিলের আবেদন পত্র বিবেচনা করা গেল না’। কিন্তু তার পরেও সেলিম হোসেন নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেননি।
তিনি একটি ভুয়া চিকিৎসাপত্র নিয়ে বিশ্রামে রয়েছেন। বরিশাল সদর হাসপাতাল থেকে দেয়া ব্যবস্থাপত্রে কোন সিল-স্বাক্ষর এমনকি তারিখ নেই। এটা সেলিমের বানানো। এ ব্যাপারে বিভাগীয় পরিচালক ডাঃ মাহাবুবুর রহমান বলেন, আমিও শুনছি সে নাকি বরিশাল সিভিল সার্জন কার্যালয়ে যোগদান করবে। কিন্তু কোন ক্ষমতাবলে সে যোগদান করবে সেটা আমাদের দেখতে হবে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছে। তার পরেও কোন কাগজের ক্ষমতায় আসবে সেটা কাগজপত্র দেখি তার পরে বলা যাবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বদলি ঠেকাতে জোর তদ্বির চালাচ্ছেন দুর্নীতিবাজ সেলিম হোসেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বদলি হওয়ার পরেও তিনি বরিশাল সিভিল সার্জন কার্যালয়ে গিয়ে বসছেন। প্রশ্ন উঠেছে একজন কর্মচারীর খুটির জোর কোথায়?
দুর্নীতির অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় গত ৭ নভেম্বর সেলিমকে ঝালকাঠী সিভিল সার্জন কার্যালয়ে বদলি করা হয়। এতে বলা হয় আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদানের কথা। কিন্তু এখনো নতুন অফিসে যোগদান করেনি সেলিম।
বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পরে দুর্নীতিবাজ কর্মচারী সেলিমের বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি নজরে আসে বর্তমান বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের । এর পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বরিশাল থেকে গত মাসে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তিন সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটির প্রধান করা হয় বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য উপ-পরিচালক ডাঃ বাসুদেব কুমার দাসকে। কমিটিতে আরো ছিলেন, সহকারি পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রক) ডাঃ আব্দুর জব্বার হাওলাদার এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফরিদউদ্দিন মৃধা।
তারা তদন্ত করে সেলিমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা পান। তদন্ত কমিটির সুপারিশ ক্রমেই স্টেনো সেলিমকে বদলির সুপারিশ করা হয়।টানা দুই যুগ একই কর্মস্থলে কর্মরত থেকে সরকারী সকল সুযোগ সুবিধা নিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, সিভিল সার্জন দপ্তরের স্টেনো টাইপিষ্ট মোঃ সেলিম হোসেন। তার যন্ত্রনায় অফিসের কর্মকর্তা থেকে অনেকেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। চিকিৎসকদের বদলি করা, দাপ্তরিক কাজে বিভিন্ন সুপারিশ, অসুস্থতাজনিত কারন দেখিয়ে কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক অবসরে যাবার সময়, ডায়াগনোস্টিক এবং ক্লিনিকের অনুমোদন ও নবায়ন করাসহ বিভিন্ন কাজে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে সেলিমের বিরুদ্ধে।
তার এইসব অনিয়মের ফলে বরিশাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকও বিব্রত ছিলেন।বরগুনা সিভিল সার্জন অফিসে স্বাস্থ্য সহকারি পদে প্রথম চাকুরীতে যোগদান করেন সেলিম। ১৯৯২ সালে ষ্টেনো টাইপিষ্ট হিসাবে বরিশাল সিভিল সার্জন অফিসে যোগদান করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি তার কোন বদলি হয়নি। দীর্ঘ বছর একই দপ্তরে চাকুরী করার সুবাধে বিভিন্ন ডায়াগনোস্টিক, ক্লিনিকের মালিকদের সাথে তার একটি সখ্যতা গড়ে ওঠে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র নবায়ন, নতুন রেজিষ্ট্রেশন, সার্ভে সনদসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র দেখভালের দায়িত্ব পায় ষ্টেনো সেলিম। আর এতেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছেন তিনি।
জেলায় ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নবায়ন করার সরকারী ফি নতুন ১১‘শ টাকা ভ্যাটসহ। সেখানে ষ্টেনো সেলিম বিশ হাজার টাকা আদায় করেন। ক্লিনিকে ভ্যাটসহ নবায়ন ফির সরকারি ধার্য্য ৭ হাজার ৫শ’টাকা। এক্ষেত্রে ষ্টেনো সেলিম কম করে হলেও বিশ হাজার টাকার নির্ধারণ করে দেন। যারা তার কথামত চলে না তাদের পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি। বিভিন্ন অজুহাতে তাদের কাগজপত্র আটকে দেয়া হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গৌরনদী-আগৈলঝড়া উপজেলার কয়েকটি ক্লিনিক ও ডায়াগনোষ্টিক থেকে এ ধরনের অর্থ উত্তোলন করেন। যার মধ্যে মৌরি ক্লিনিক গৌরনদী,আগৈলঝাড়ায় আদর্শ জেনারেল হাসপাতাল, একই এলাকার দুস্থ্য মানবতা হাসপাতাল থেকে নবায়ন বাবদ বিশ হাজার টাকা নিয়েছেনন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও নগরীর বিভিন্ন ডায়াগনোস্টিক সেন্টার থেকে মাসিক মাসোহারা আদায় করে বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে। নগরীর এমন ১০/১৫ ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার রয়েছে যাদের কোন লাইসেন্স বা কাগজপত্র নেই। ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মাসিক মাসোহারা আদায় করা হয় বলেও জানা গেছে। এমনকি যে সব চিকিৎসক সিভিল সার্জন অফিসে কর্মরত আছেন তাদের বদলি বা পদায়ন অথবা যেকোন অফিস আদেশ লেখার জন্য তাকে (সেলিম) দাবীকৃত অর্থ পরিশোধ না করলে কাজ সমাপ্ত করতে গড়িমসি করে বলে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। বরিশাল সিভিল সার্জন দপ্তরে সাবেক এক চিকিৎসকের পদোন্নতি হওয়ার ফরোয়াডিং লিখে দেয়ার জন্য জোরপূবক অর্থ আদায় করেছিল যা ওই চিকিৎসক নিয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছিলেন। সম্প্রতি যে সকল কর্মচারীরা স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়েছে তাদের কাগজপত্র ঠিক করে দেয়ার কথা বলে অর্থ আদায় করেছে।
স্টেনো সেলিম তার এই সকল অবৈধ কর্মকান্ডকে বৈধতার ছোঁয়া লাগাতে অগোচরে বুঝিয়ে দেন এই বলে যে ‘বরিশাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ও অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এই আদায়কৃত অর্থের ভাগ দিতে হয়। সবচেয়ে বড় দান মারার সুজোগটি হচ্ছে ক্লিনিকের নতুন লাইসেন্স অনুমোদনের ক্ষেত্রে। এই লাইসেন্স দেয়া হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। আর তাই ষ্টেনো সেলিম ক্লিনিক মালিকদের এই বলে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে ‘যেহেতু ঢাকা থেকে অনুমোদন করিয়ে আনতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন তাই কমপক্ষে ৭০/৮০ হাজার টাকা। অনেক ক্ষেত্রে লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। অথচ নিয়ম মাফিক লাইসেন্স করলে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা প্রয়োজন হয়। যার বড় অংশ জমা হয় সরকারি কোষাগারে।