পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ২১ বছর পূর্তি।প্রায় দুই দশকেরও বেশি পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎকালীন শান্তি বাহিনীর রক্তের হোলি খেলার অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি।১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের পক্ষে তৎকালিন চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লার সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা।
শান্তি চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে শান্তি বাহিনীর শীর্ষ গেরিলা নেতা সন্তু লারমা তার বিপুলসংখ্যক সহযোগীদের নিয়ে অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। সরকার তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ প্রদান করে।
শান্তি চুক্তির পর কেটে গেছে বিশটি বছর। একের পর এক চুক্তির বিভিন্ন শর্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে পাহাড়জুড়ে। এরপরও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কম বেশি বিতর্ক রয়েছে। সরকারের দাবি চুক্তির অধিকাংশ ধারাই ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। অবশিষ্ট কিছু ধারা বাস্তবায়নাধীন। তবে জেএসএসের এ শান্তি চুক্তি সম্পাদনের বিরোধিতায় রয়েছে সংগঠনটির বিবদমান একটি গ্রুপ। পরবর্তীতে যারা ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট) নামে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করে। যারা এ দিনটিকে ‘গণগ্লানি দিবস’ নামে আখ্যায়িত করেছে। অপরদিকে, বাঙালীদের সংগঠন সম অধিকার আন্দোলন এ দিনটিকে কালো দিবস আখ্যা দিয়ে তিন পার্বত্য জেলায় পালন করবে নানা কর্মসূচী।
শান্তি চুক্তির পর জেএসএসের সামরিক উইং শান্তি বাহিনী বিলুপ্ত ঘোষিত হয়েছে। এ উইংয়ের সদস্যদের অনেককে সরকার নানাভাবে পুনর্বাসিত করেছে। এর পাশাপাশি পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য গত বিশ বছরে যে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয়ে নানা স্থাপনা প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা অভাবনীয় হলেও জেএসএসবিরোধী গ্রুপের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ অব্যাহত রেখেছে। যে কারণে গত দুই দশকে জেএসএস ও ইউপিডিএফের বিভক্ত চার গ্রুপ নিজেদের ও আইনশ্ঙ্খৃলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন পয়েন্টে সংঘর্ষে জড়িয়ে এ পর্যন্ত সাত শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক প্রাণ হারিয়েছে। অন্তর্কোন্দলে জড়িয়ে থাকা এসব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিযোগ রয়েছে। মূলত গেরিলা যুদ্ধের অবসান ঘটে শান্তি প্রতিষ্ঠা হলেও জেএসএস ও ইউপিডিএফের অন্তর্কোন্দলে এখনও প্রতিনিয়ত রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে সবুজের পাহাড়। ফলে সামগ্রিক অর্থে শান্তির সুবাতাস বয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও এতে ঝরছে তাজা প্রাণ। চুক্তির পর একে একে কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠন জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ (প্রসিত) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষের অবসান ঘটছে না। এতে করে পাহাড়জুড়ে পাহাড়ী-বাঙালীদের মাঝে আতঙ্কের অবসান এখনও ঘটেনি।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আজ তিন পার্বত্য জেলায় ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে পার্বত্য শান্তি চুক্তির একুশ বছর পূর্তি পালনের ব্যাপক কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে জেএসএস (সন্তু) ও জেএসএস (লারমা) গ্রুপ পৃথক পৃথক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। অপরদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদনকে দল ও সরকারের জন্য বড় সাফল্য- এ বিবেচনায় তিন পার্বত্য জেলায় আওয়ামী লীগও নানা কর্মসূচী পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। শান্তি চুক্তির অন্যতম ফসল প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য জেলা পরিষদ দিনব্যাপী আনন্দ উল্লাসের পাশাপাশি বর্ণাঢ্য র্যালি, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং তিন পার্বত্য জেলায় সেনাবাহিনীর উদ্যোগে কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে। রাঙ্গামাটি স্টেডিয়ামে স্থানীয় সেনা রিজিওন যে কনসার্টের আয়োজন করেছে তাতে দেশবরেণ্য শিল্পীদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। রাঙ্গামাটি সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হবেন। এর পাশাপাশি শান্তি চুক্তির বর্ষপূর্তি জেএসএসের উদ্যোগে কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায়ও পালনের কর্মসূচী নেয়া হয়েছে।
এদিকে বাঙালীদের সংগঠন সমঅধিকার আন্দোলন চুক্তি সম্পাদনের এ দিনটিকে কালো দিবস আখ্যায়িত করেছে। তাদের উদ্যোগে তিন পার্বত্য জেলায় প্রতিবাদ দিবস পালন করবে। সম অধিকার আন্দোলনের পক্ষ থেকে চুক্তি বাতিলের পরিবর্তে কিছু ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করে এর সংশোধন চাওয়া হচ্ছে। এছাড়া চুক্তির বিরুদ্ধে শুরু থেকেই ইউপিডিএফ দিনটিকে গণগ্লানি দিবস পালন করে আসছে। এ উপলক্ষে তাদের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির শর্তানুযায়ী ১৯৯৮ সালের ৬ মে প্রতিষ্ঠা করা হয় স্থানীয় সরকার পরিষদ। আইন সংশোধনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন সংসদে পাস হয়। গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। এরপর একে একে চলে আসছে উন্নয়নের এক মহাযজ্ঞ। যার প্রেক্ষাপটে গত ২০ বছরে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি পূর্ণ বাস্তবায়ন, ১৫টির আংশিক বাস্তবায়ন এবং ন’টি ধারার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলায় হস্তান্তরযোগ্য ৩৩টি বিষয়ের মধ্যে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবান জেলা পরিষদে ২৮টি বিষয় হস্তান্তর করা হয়েছে।
চুক্তির পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে ব্যাপক উন্নয়ন সাািধত হয়েছে এবং উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। যার প্রেক্ষাপটে পাহাড়ের মানুষ অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে। স্বাধীনতার আগে পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে ছিল ৪১ কিলোমিটার সড়ক। যা বর্তমানে ১ হাজার ৫৩৫ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে অসংখ্য ব্রিজ ও কালভার্ট। পাশাপাশি তিনটি স্থলবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনাও নিয়েছে সরকার। এসবের পাশাপাশি টেলিযোগাযোগের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি ১২০টি এনজিও কাজ করছে সামগ্রিক উন্নয়নে। এসবের পাশাপাশি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর উদ্যোগে বিপুলসংখ্যক উন্নয়ন পরিকল্পনা ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। যা পাহাড়ী-বাঙালী নির্বিশেষে সকলের জন্য বড় ধরনের সুফল বয়ে এনেছে।
এরপরও পাহাড়ী কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে এক ধরনের অস্থির ও ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। অভ্যন্তরীণ পক্ষ-বিপক্ষ গ্রুপের সশস্ত্র তৎপরতা, অপহরণ, খুন, গুম, চাঁদাবাজি ইত্যাদি ঘটনা মাঝেমধ্যে ঘটে চলেছে। যা সবুজ পাহাড়ের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এদিকে, সন্তু সমর্থিত জেএসএস এ দিনটিকে ‘প্রতিশ্রুতি নয়, চুক্তির প্রকৃত বাস্তবায়ন চাই’- এ স্লোগানে নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। জেএসএস এর কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সচিব চাকমা জানিয়েছেন, চুক্তির একুশ বছর পূর্তি সামনে রেখে তাদের সংগঠন আজ জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করবে।
এছাড়া ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে হবে আলোচনা সভা। এর পাশাপাশি খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানেও নানা কর্মসূচী পালিত হবে। পক্ষান্তরে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদনকে আওয়ামী লীগের জন্য বড় সাফল্য দাবি করে তিন পার্বত্য জেলায় আওয়ামী লীগ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ পালন করবে নান কর্মসূচী। বিপরীতে বাঙালীদের সম অধিকার আন্দোলন পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদ দিনটিকে কালো দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তুতি নিয়েছে।