34 C
Dhaka
জুলাই ১২, ২০২৫
Bangla Online News Banglarmukh24.com
জাতীয়

সাবেকি নিয়ন্ত্রণ কৌশল,আধুনিক বাজার

বাজার মানেই পণ্যের পসরা। বাজারে পণ্যের বৈচিত্র্য যেমন থাকে, তেমনি থাকে পণ্য বিপণনের হাজার ধারা। একই পণ্য কেউ বেচে সুরম্য দালানে বসে, কেউ বেচে পথের ধারে ছোট্ট দোকানে বসে, আবার কেউ পণ্য নিয়ে হাজির হয় ক্রেতার দ্বারে দ্বারে। বিচিত্র সব পণ্যের ততোধিক বিচিত্র বিপণন পন্থা—এসব নিয়েই বাজার। খেলার মতোই এই বাজারে থাকে প্রতিযোগিতা। আর প্রতিযোগিতা মানেই নিয়ম, না হলে মাৎস্যন্যায়ই একমাত্র পরিণতি, যা কখনো কাম্য নয়।

ফুটবল খেলার কথাই ধরা যাক। ফুটবলকে বলা হয় গোলের খেলা। সাদা চোখে বিষয়টা ঠিক আছে। কিন্তু এই কথাকেই একমাত্র সত্য ধরে নিলে ফুটবল খেলা কুস্তিতে পরিণত হতে সময় লাগবে না। কারণ, প্রতিটি পক্ষ তখন যেকোনো মূল্যে গোল করাটাকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করত। তেমনটি যেন না হয়, সে জন্য ফুটবল মাঠে অবধারিতভাবে প্রবেশ করতে হয় কিছু নিয়মের। আর এই নিয়মের সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করতে হয় তার পাহারাদার রেফারির, যার কাজ হচ্ছে সব ধরনের ফাউলের পথ রোখা। এক কথায় খেলায় যেকোনো ধরনের অন্যায্যতা রোখাই রেফারির দায়িত্ব। এমন প্রতিটি খেলাতেই রয়েছে।

আরও ভালোভাবে বললে প্রতিযোগিতা যেখানে, সেখানেই নিয়ম ও রেফারির উপস্থিতি স্বাভাবিক। বাজারের ক্ষেত্রেও তা-ই। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি রাষ্ট্র নিজ নিজ বাজারে অন্যায্যতা রুখতে কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করে, যাদের কাজ রেফারির মতোই। কেউ যেন ভাঁওতা দিয়ে অন্যকে বাজার থেকে হটিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করতে না পারে, অর্থাৎ প্রতিযোগিতার পরিবেশটি যেন বজায় থাকে, সে চেষ্টাই করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নামের এই রেফারি। বর্তমান বিশ্বগ্রামে রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ন্ত্রকের উপস্থিতিও।

নানা নামে, নানা চুক্তি ও সমঝোতার আড়ালে বাজারের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখাই যার উদ্দেশ্য। কিন্তু এখন এই নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোই নাকি আর কাজ করছে না ঠিকমতো।

ধনী দেশগুলোর বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ টিকিয়ে রাখতে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো আগের মতো আর কাজ করছে না। যদিও বাজার নিয়ন্ত্রক ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বর্তমান অবস্থাকে ২০০৮-০৯ সময়ের তুলনায় অনেক ভালো বলে ব্যাখ্যা করছেন। তাঁরা সে সময়ের মন্দা পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনাগুলোকে খণ্ডন করছেন। তাঁরা বহু বছর ধরে একটু একটু করে তৈরি হওয়া বর্তমান বাজারব্যবস্থার বিভিন্ন নিয়ম-নীতির গর্বিত রক্ষাকর্তা।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো তাদের বিদ্যমান নিয়ম-নীতিগুলোকে অনেকটা পবিত্র জ্ঞান করে। পশ্চিমা বাজারব্যবস্থার অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অর্থনীতিতে বিদ্যমান প্রতিযোগিতার মাত্রা নিয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত নয়। এ ক্ষেত্রে তারা কোনো ধরনের জবাবদিহি করতে একরকম অনিচ্ছুক। বরং তারা এ ক্ষেত্রে বলে, অর্থনীতিতে বিদ্যমান প্রতিযোগিতার মাত্রা নিরূপণ এক কথায় অসম্ভব। কিন্তু এটা তো সত্য যে এই জবাবদিহি এড়িয়ে যাওয়ার ফুরসতে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ভয়াবহ মাত্রার শক্তি অর্জন করেছে, যা কখনো টেকসই হতে পারে না এবং যার পরিবর্তন প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও এ–সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ধাঁচ অনেকটা একই। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের ওপর নজরদারির কাজটি করে ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) ও বিচার মন্ত্রণালয় (ডিওজে)। এর মধ্যে কংগ্রেসের কাছে এফটিসির জবাবদিহির বিধান রয়েছে। ইউরোপে রয়েছে ইউরোপীয় কমিশনের পাশাপাশি ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) বিভিন্ন দেশের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান।

কমিশনের ক্ষমতা রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দেওয়ার, যারা আবার আদালতে আপিল করতে পারে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো গুটিকয় অস্পষ্ট আইন দ্বারা পরিচালিত। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অনুসৃত হয় শারম্যান অ্যাক্ট ও ট্রিটি অব রোম। ১৮৯০ সালে প্রণীত শারম্যান অ্যাক্ট মাত্র ৭৬৯ শব্দের। আদালতে এই আইনগুলোর ব্যাখ্যা একেক সময় একেক রকম হতে দেখা গেছে।

সারা বিশ্বেই বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত সংস্থাগুলো ভোক্তার কল্যাণকেই তাদের একমাত্র লক্ষ্য বলে প্রচার করে। মোটাদাগে অনিয়মের জন্য শাস্তি বিধান, একাধিক প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণে তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা এবং বড় প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়াকরণের লক্ষ্যে শক্তির অপপ্রয়োগ রোখা এসব সংস্থার কাজ। এক কথায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো একই সঙ্গে পুলিশ ও বিচারকের ভূমিকায় থাকে। বাংলাদেশে কিছুদিন আগে দুটি টেলিকম কোম্পানি একীভূত হয়েছে। দীর্ঘ এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বিটিআরসি) ছিল এই রেফারির ভূমিকায়। সমস্যা হচ্ছে সময়ের সঙ্গে বাজারব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণ কমছে। ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, ১৯৭০ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাজারে কোনো প্রতিষ্ঠানের অনৈতিক প্রভাব বিস্তারের বিপরীতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ধারাবাহিকভাবে কমেছে।

অন্যদিকে, ইউরোপে এই ভূমিকা একটি জায়গাতেই স্থির হয়ে আছে, যা সংস্থাগুলোর তৎপরতা কমারই নামান্তর। কারণ, এই সময়ের মধ্যে বাজারের পরিসর বেড়েছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাজার এক জায়গায় স্থির নেই। সময়ের সঙ্গে এটি বিস্তর বিবর্তিত হয়েছে। নতুন নতুন বহু ধারণা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বাজার এখন আর আগের মতো স্থাননির্ভর নয়। প্রতিটি স্থানই বাজার। প্রতিটি অনুষঙ্গ এখন পণ্য। মুখের হাসি থেকে শুরু করে সবকিছুই এখন পণ্যে রূপান্তরিত। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে বন্ধুত্বও এখন পণ্য। আবার এসব পণ্যও সচল।

গতিশীল এই বিশ্বে ব্যস্ত মানুষের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে পণ্য বলছে, ‘আমাকে নাও’। এক পণ্যের গায়ে লেপ্টে থাকছে আরেক পণ্যের বিজ্ঞাপন। পুরো বাজারকাঠামোতেই এত এত পরিবর্তন হয়েছে, যে তা বলে শেষ করা যাবে না।

ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত বাজারকাঠামোতে এখনো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো রয়ে গেছে অনেকটা আগের মতোই। তেমন কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি না এর হাতিয়ারে, না এর কর্মপন্থায়। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সবচেয়ে বড় ঘাটতি হচ্ছে এর কৌতূহলের অভাব। অথচ পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে খেলোয়াড়েরা ঠিকই নিজেদের অভিযোজিত করে নিয়েছে।

নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করে নিজেদের উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত—সবকিছু ঢেলে সাজিয়েছে তারা। এদিকে নতুন প্রতিযোগী বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। পূর্বতন নানা নিয়ম সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পেটেন্ট ও তার মেয়াদকাল নিয়ে বিতর্কটি সামনে আনা যায়। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের কারণে বাজারে যে অসাম্য সৃষ্টি হচ্ছে, তা নিয়ে ২০১৫ সালে গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেন জ্যাসন ফারম্যান ও পিটার অর্সজ্যাগ।

ইকোনমিস্ট বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের এফটিসি ও ডিওজে অনেক পিছিয়ে আছে। বর্তমান অর্থনীতি সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। অবশ্য দুটি ক্ষেত্রেই শীর্ষে এখন নতুন লোক, যারা চাইলে বদল ঘটতে পারে। ইউরোপের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। তারা ডিজিটাল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের বদলে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে।

রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এখনো প্রতিযোগিতার সংজ্ঞাই নির্ধারণ করতে পারেনি। ফলে এর অনুপস্থিতিতে অবস্থা কী হবে বা হতে পারে, তা নিয়েও একধরনের অস্পষ্ট অবস্থান তাদের। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান পূর্বতন মানদণ্ডগুলো নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, অনেক সময় দাম কমে গেলেও ভোক্তারা বিপদে পড়তে পারে। আবার এখন আর অর্থমূল্য দিয়েই সব পণ্যের দাম নিরূপণ সম্ভব নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানই ডেটার মাধ্যমে লেনদেন করে। তৃতীয় আরেকটি বড় সংকট হচ্ছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে পার্থক্য। আর্থিক খাতের সক্ষমতা বিচারের নতুন তত্ত্ব হাজির হয়েছে। কিন্তু এই নতুন তত্ত্বও ২০০৮–এর পরিণতির ঝুঁকিকে সামনে আনা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। আবার প্রচলিত নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিযুক্ত আইনি পরামর্শকদের এ ক্ষেত্রে খুব একটা গুরুত্বও দিচ্ছে না। ফলে, তার পক্ষে কখনোই হালনাগাদ হওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

কিন্তু সময় তো বসে নেই। বসে নেই প্রযুক্তিও। নতুন নতুন ধারণা আসছে। বাজার সম্প্রসারিত হয়ে পৌঁছে গেছে শয়নকক্ষে। ফলে, এই সময়ে পুরোনো নিয়ম ও পুরোনো ধারার রেফারি দিয়ে আর চলছে না। কিন্তু এই সত্যকে এখনো অনেকেই স্বীকার করে নেয়নি। গোটা বিশ্ব দূরে থাক, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো অঞ্চলেই এই সত্য বিরাজ করছে। আশার কথা এই যে জার্মানিতে দেরিতে হলেও কাজ শুরু হয়েছে।

২০১৭ সালে দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা বুন্দেসকার্টেলমাটকে যুগোপযোগী করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল যুগের বিষয়টিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই পথে বিশ্বের অন্য দেশগুলোও অগ্রসর হবে, এমনটাই প্রত্যাশা করছেন বিশ্লেষকেরা।

সম্পর্কিত পোস্ট

আইন-বিধি মেনে কাজের গতি বাড়ানোর তাগিদ

banglarmukh official

আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যার বিচার ৭ দিনের মধ্যে শুরু হবে: আইন উপদেষ্টা

banglarmukh official

শুক্রবার কক্সবাজার যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ও জাতিসংঘ মহাসচিব

banglarmukh official

শিশু আছিয়ার মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক, দ্রুত বিচার নিশ্চিতের নির্দেশ

banglarmukh official

২০২৬ সালেই বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণ করা হবে

banglarmukh official

জাতিসংঘ মহাসচিব ঢাকায়

banglarmukh official