লড়াইটা ছিল স্বাধীনতার জন্য। বাঙালির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই। এই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেটরিতে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক নৌকা মার্কার পক্ষে রায় দেয় গোটা পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী জনতা। তখনই চূড়ান্ত হয়ে যায় বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিপথ। দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধের পথে বাঙালি জাতিকে পরিচালিত করেন।
নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও ইয়াহিয়ার সরকার নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে টালবাহানা শুরু হয়। কিন্তু অনড় বঙ্গবন্ধু জনগণের প্রত্যাশা বুঝেই আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যের শপথবাক্য পাঠ করান। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অজুহাত খুঁজতে থাকে সামরিক সরকার। এরই মধ্যে ১ মার্চ, হঠাত্ গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। স্ফুলিঙ্গের মতো আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে গোটা ঢাকায়। উত্তাল মার্চে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় পল্টন ময়দান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর ফার্মগেট এলাকা।
আমরা ফার্মগেট এলাকায় প্রতিদিন মিটিং-মিছিল করি। ছাত্রলীগের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ এবং সর্বস্তরের মানুষ আমাদের আন্দোলনে যোগদান করত। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমরা নিজেদের প্রস্তুত রাখি। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশ-গেটের দুই কিলোমিটারের মধ্যেই ফার্মগেট এলাকায় তখন প্রতিদিনই ব্যারিকেড দেওয়া হয়। মিছিলে মিছিলে উত্তাল থাকত রাজপথ।
আমাদের জমায়েত হওয়ার স্থান ছিল তত্কালীন ইউনাইটেড ব্যাংক ও হাবিব ব্যাংকের সামনে (বর্তমানে আল রাজি হাসপাতালের সামনে)। স্বাধীনতার জন্য আবালবৃদ্ধবনিতা সবার মধ্যেই দেখতাম উন্মাদনা। সবার দাবি তখন ছিল একটাই, স্বাধীনতা। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে আমাদের কাছে খবর ছড়িয়ে পড়ে, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বের হতে পারে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ২৫ মার্চ ফার্মগেটে একটি পরিখা খননের জন্য পরামর্শ দেন। পরিখা খনন অসম্ভব ছিল; কারণ ফার্মগেটের পাশে আর্মিদের অবস্থান ছিল। পরিখার বদলে আমরা ফার্মগেটে বড়ো দুটি গাছ কেটে গাছের গুঁড়ি ও লোহালক্কড় দিয়ে ব্যারিকেড দিই। তেজগাঁও ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে আমার আহ্বানে আন্দোলনকারীরা ব্যারিকেড তৈরিতে সহযোগিতা করেন। তেজগাঁও এলাকার শ্রমিকরাও এতে যোগ দেন।
২৫ মার্চ দিনভর মিছিল-মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিল ফার্মগেট এলাকা। সেদিন তেজগাঁও আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশে কড়ইগাছের গুঁড়ি, পুরোনো গাড়ি, লোহার স্তূপ জমিয়ে তৈরি করা হয় ব্যারিকেড। রাত ১০টার দিকে আস্তে আস্তে কমতে থাকে ফার্মগেটের জনসমাগম। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি কতটা ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। ভয়াল সেই কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করতেই অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা চূড়ান্ত হয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সাঁজোয়া যান প্রস্তুত থাকে; যাদের গন্তব্য ছিল রাজারবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পিলখানা। আমরা রাতে ফার্মগেটের কৃষি বিভাগের বাগানের ভেতরে প্রস্তুত থাকি। আর অপেক্ষা করতে থাকি, কখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে সাঁজোয়া যান বের হবে। এ সময় আমাদের সঙ্গে যোগ দেন তেজগাঁও থানার দুই পুলিশ সদস্য। তারা তত্কালীন ইউনাইটেড ও হাবিব ব্যাংকের ছাদে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে পজিশন নেয়। সারাদিন মিছিল-মিটিংয়ের পর সন্ধ্যায় ফার্মগেট এলাকায় জনসমাগম কমে আসে।
রাত ১০.৪৫ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হতে থাকে ঘাতক সেনাদের কনভয়। আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর কনভয় এগিয়ে আসতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফার্মগেটের সামনে এসে আমাদের বাধার মুখে এবং ব্যারিকেডের সম্মুখে এসে কনভয়ের গতি থেমে যায়। বুলডোজার দিয়ে ব্যারিকেড সরানোর কাজ শুরু করে, পাশাপাশি তাদের অস্ত্র দিয়ে জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যারা জয়বাংলা স্লোগান দিচ্ছিল। রাতের নীরবতা ভেঙে শুরু হয় কামান আর অস্ত্রের গর্জন। আমরা বাগানের ভেতরে অপেক্ষায় থাকি।
ফার্মগেট এলাকায় প্রতিরোধের প্রথম ব্যারিকেড গুঁড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে যায় আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাতকেরা। গোলাগুলির কারণে আমরা হামাগুড়ি দিয়ে আত্মরক্ষা করি; কিন্তু আমাদের বুকে ছিল অসীম সাহস।
পাকিস্তান ঘাতকেরা ফার্মগেট এলাকায় প্রতিরোধের মুখে পড়ে আরো সতর্ক হয়ে যায়। ফার্মগেটের প্রতিরোধের ইতিহাস জানা যায় পাকিস্তানি ঘাতক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ঘনিষ্ঠ মেজর সিদ্দিক সালিকের লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে। বইটির ৭৩ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে—২৫ মার্চ রাতে ফার্মগেটে মুক্তিকামী বাঙালির প্রতিরোধের কথা। যার বাংলা সারমর্ম হলো—‘ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়া প্রথম সেনাদলটি বাধারমুখে পড়ে ফার্মগেট। ক্যান্টনমেন্ট থেকে যার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। সদ্য কাটা বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি রাস্তায় আড়াআড়িভাবে ফেলে প্রথম দলটিকে থামিয়ে দেওয়া হলো। পুরোনো গাড়ির খোল এবং অকেজো স্টিমরোলার টেনে এনে রাস্তার পাশের ফাঁকা অংশও আটকে দেওয়া হয়।
ব্যারিকেডের ওপাশ থেকে আওয়ামী লীগের অন্তত কয়েক শ কর্মী দাঁড়িয়ে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে। জেনারেল টিক্কাখানের সদর দপ্তরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি তাদের তেজোদীপ্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হলো—মুহূর্তেই সেনাদের রাইফেলের গুলির শব্দ ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের সঙ্গে মিশে যেন একাকার হয়ে গেল। একটু পরেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে বিস্ফোরণ বাতাসে তীক্ষ শব্দ তুলল। এরপর কিছক্ষণ ধরে গগনবিদারী স্লোগান ও গুলির শব্দের সঙ্গে হালকা মেশিনগানের গুঞ্জন বাতাসে ভেসে থাকল। পনেরো মিনিট পরে গোলমালের শব্দ কমে এলো এবং স্লোগানের আওয়াজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে এক সময় থেমেই গেল। স্পষ্টতই অস্ত্রের জয় ঘটল। সেনাদল শহরের ভেতরের দিকে এগিয়ে গেল।’
ফার্মগেটে প্রতিরোধের ব্যারিকেড ভেঙে দিয়ে এগিয়ে যায় ঘাতক দল। বাংলামটর এলাকায় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করে। এরপর রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর পিলখানা এলাকায় ছুঁটে যায় সেনা কনভয়। রাজারবাগে বাঙালি পুলিশ ভাইয়েরা আগেভাগেই প্রস্তুত ছিলেন। প্রতিরোধ গড়ে ইতিহাস রচনা করে বাঙালি বীর পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ সদস্যরা হতাহত হন এবং তারা পাকিস্তানি আধুনিক সমরাস্ত্রের সামনে টিকতে পারেনি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাতকেরা রাজারবাগ দখলে নেয়। পুলিশ সদস্যদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে রক্তাক্ত রাজারবাগে রচিত হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাস।
ফার্মগেটে প্রতিরোধের প্রথম ব্যারিকেড গুঁড়িয়ে দিলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের মনোবল ভেঙে দিতে পারেনি। কারণ আমরা ট্রেনিং নিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয় অর্জন করি। এই স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ বাঙালি শহিদ হয়েছেন। ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এই স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।