নানা কায়দা-কৌশলে বরিশালে ইয়াবা ব্যবসা এখন তুঙ্গে। কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও গোপনে সক্রিয় জেলার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। কেউ কেউ প্রথমে মাদক কারবারিতে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ার পর এই ব্যবসার কৌশলও পাল্টে ফেলেছে। এখন ভালো মানুষের বেশ ধরে অনুসারীদের মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। এমনকি মাদকের ডিলাররা এক শ্রেণির তরুণী বা নারীদের টার্গেট করে কৌশলে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে সুযোগ মতো আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও ধারণ করছে। তারপর সেই নারীকে বাধ্য করা হচ্ছে ইয়াবা সরবরাহের কাজে।
এভাবেই বরিশাল শহরের নতুবাজার, কাউনিয়া, রহমাতপুর, সাগরদী, বাবুগঞ্জ, পলাশপুর, ভাটিখানা, টিয়াখালী, রূপাতলী, কাশিপুরসহ বরিশাল জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মাদকের ভয়ঙ্কর জাল। সম্প্রতি কয়েকদিন বরিশালে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে এমনই তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে বরিশাল রেঞ্জ ডি আইজি মো: শফিকুল ইসলাম মাদকের বিরুদ্ধে বরিশাল বিভাগ জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছে। নিয়মিত অভিযান চালিয়ে মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। যারাই মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একাধিক মাদকসেবী, বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,বরগুনা,পিরোজপুরসহ কয়েকটি রুট দিয়ে সবচেয়ে বেশি মাদকের চালান শহরে ঢুকছে। তবে নদীপথে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য ঢুকছে এ জেলায়। মাদক বিক্রির কাজটি এখন বেশি করছে মাদকসেবীরাই।
বরিশাল শহরের সাকিল নামে একজন মাদকসেবী নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিলারদের কাছ থেকে সেবনকারীরা ১৫-২০টি ইয়াবা কিনছে পাইকারি দরে। এরপর দেখা যাচ্ছে কিছু বেশি টাকায় খুচরা পর্যায়ে ১৫টি বিক্রি করছে এবং বাকি পাঁচটি নিজেই সেবন করছে। অর্থাৎ ১৫টি ইয়াবা কিনলে ৫টি ফ্রি পাওয়া যাচ্ছে। ওই ১৫টি বিক্রি করেই তার ২০টি ইয়াবা কেনার মূল্য উঠে যাচ্ছে। ফলে তার সেবনের জন্য ৫টি বিনামূল্যেই থেকে যাচ্ছে। প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন বরিশাল জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, বর্তমানে ডিলার পর্যায়ের ইয়াবা কেনাবেচা খুব কমই হচ্ছে। বেশিরভাগ সেবনকারী মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। তারপরও আগের চেয়ে মাদক তৎপরতা কিছুটা কমেছে।
এ বিষয়ে অভিযানের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলো গুরুত্বের সঙ্গে পরিচালনা করা হচ্ছে।
তিনি জানান, জেলার কিছু ওয়ার্ডে মাদকবিরোধী কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই নেশার ভয়ঙ্কর ছোবলে দিশাহারা উঠতি বয়সি তরুণ সমাজ। মাদক নির্মূলে যাদের প্রধান ভূমিকা পালনের কথা সেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বরিশাল জেলার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে চরম উদাসীন ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযানও অনেকাংশে কমে গেছে। এমনকি কোনো কোনো মাদক স্পট থেকে এক শ্রেণির পুলিশ সদস্য নিয়মিত টাকা নিয়ে মাদক ব্যবসার সুযোগ করে দিচ্ছেন বলেও ভুক্তভোগী একাধিক অভিভাবক ও স্থানীয়রা অভিযোগ করে। বরিশাল জেলা প্রশাসক বলেন, মাদকের ছোবলে তরুণরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাদকের কারণে তাদের মেধা অকেজো হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে মাদকবিরোধী অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পাশাপাশি সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রমেও বেশ জোর দেওয়া হচ্ছে।
বরিশাল বিএম কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, বরিশালে মাদকের বেশ বিস্তার লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে আমার কলেজ এলাকাতেও এর কিছু প্রভাব বোঝা যাচ্ছে। এ কারণে ইতোমধ্যেই মাদক প্রতিরোধে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কলেজের অরক্ষিত কিছু এলাকা ছিল সেগুলোও সুরক্ষিত করা হয়েছে। নিয়মিত মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক সভা-সেমিনার করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এ ব্যাপারে মাদকসেবীদের ‘মোটিভেশনের’ দিকে বেশি জোর দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া বেশি বেশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনাসহ মাদকবিরোধী অভিযানও অব্যাহত রাখতে হবে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশাল শহরের বাইরেও বর্তমানে ইয়াবার ভয়াবহ প্রভাব দেখা দিয়েছে। কিছু দিন আগে বরিশালে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওযার পর কিছুদিন এটি হ্রাস পেলেও সম্প্রতি আবারও বেড়েছে। খুচরা পর্যায়ের বা ছোট পর্যায়ে যেসব মাদক ব্যবসায়ী ছিল তারাই এখন পুরো জেলার মাদকের শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
