বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জে ছয় বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার চার শিশুকে যশোর শিশু উন্নয়ন ও সংশোধন কেন্দ্রে পাঠিয়েছে আদালত। বুধবার (৭ অক্টোবর) বিকেলে বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. এনায়েতউল্লাহ ওই নির্দেশ দেন। সন্ধ্যায় শিশুদেরকে প্রিজনভ্যানে তোলার সময়ে হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয় আদালত পাড়ায়। কথিত ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত চার শিশুর চিৎকার, আতঙ্কগ্রস্থ চেহারা আর অনুনয়-বিনয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরাও কেঁদে ফেলেন। খবর ছড়িয়ে পড়লে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বরিশালের বিশিষ্টজন।
এদিকে বৃহস্পতিবার (৮ অক্টোবর) ঘটনাস্থলে কথা হয় ওই এলাকার সংরক্ষিত আসনের ইউপি সদস্য নাজমা বেগম ও রঙ্গশ্রী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বশির উদ্দিনের সাথে। চেয়ারম্যান বশির উদ্দিন বলেন, ঘটনাটি ধর্ষণ নয়। ধর্ষণ সাজানো হয়েছে। মূলত বাদী ও বিবাদীর পরিবার আপন চাচা-ভাতিজা। উভয় পক্ষের মধ্যে ১৫ শতাংশ জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। এ নিয়ে অসংখ্যবার শালিস আমি নিজেও করেছি। পুরানো শত্রুতার জের ধরে এই মামলা।
ইউপি সদস্য নাজমা বেগম বলেন, ধর্ষণ হয়েছে বলে আমার কাছে কোন তথ্য নেই। আমি তাদের প্রতিবেশী। তাছাড়া ধর্ষণ ৪ তারিখ হলে মেয়ের গোপনাঙ্গে ৬ তারিখতো ব্যথা লাগতে পারেন না।
তবে বাকেরগঞ্জ থানার ওসি আবুল কালাম বলেছেন, মামলার সঙ্গতি বা অসঙ্গতি নিয়ে আমি কোন কথা বলতে পারবো না। এ বিষয়ে আমাদের এ্যাডিশনাল এসপি স্যার কথা বলবেন। এটুকু বলবো, আমরা অভিযোগ পেয়েছি ধর্ষণের, আসামীদের গ্রেফতার করেছি।
গ্রেফতার হওয়া ওই চার শিশু হলো মো. সাইদুল ইসলাম (১১), মো. সোলায়মান ইসলাম তামিম (১০), মো. হাফিজুল ইসলাম লাবিব (১০) ও মো. শাওন হাওলাদার (১০)। এদের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নে রুনসি গ্রামে। এজাহারে এদের বয়স ১০ ও ১১ বছর দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনজনের বয়স ৯ বছর এবং ৯ বছর তিন মাসের মধ্যে। আর সাইদুলের বয়স দশ বছর দুইমাস বলে স্বীকার করেছেন ওসি আবুল কালাম।
মামলার বাদী জাহিদুর রহমান রুবেল এজাহারে উল্লেখ করেছেন, ৬ বছরের তার কন্যা শিশুটির খেলার সাথী ওই চার শিশু দ্বারা ৪ অক্টোবর বিকেলে তাদের বানানো খেলার ঘরে ধর্ষণ করে। এ বিষয়ে বাদী জাহিদুর রহমান রুবেলের কাছে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে রাজি হননি।
তবে প্রতিবেশীরা বলছে ভিন্ন কথা। তারা বলছেন জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরেই এদেরকে ফাঁসানো হয়েছে।
প্রতিবেশী কালাম হাওলাদার, নাসির উদ্দন জানান, ধর্ষণের কোন ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই। মামলার বাদী রুবেল ও গ্রেফতার হওয়া শিশুদের পিতার সাথে জমির শরিক নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ চলছে। সে কারনে এ ধরনের মামলা হতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।

যা বললেন বরিশালের বিশিষ্টজন
বাকেরগঞ্জে কথিত ধর্ষণকান্ডে চার শিশু গ্রেফতারে এই বিষয়ে বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। তারা ঘটনার নেপথ্যের কারন কিংবা এটি আদৌ কোন ধর্ষণ ঘটনা কিনা তা খতিয়ে দেখার দাবী জানান।
আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের সংজ্ঞা বদলে ফেলেছে বাকেরগঞ্জের এই মামলাটি। তাদের মতে ১০ বছরের শিশুদের শরীরে শুক্রানু তৈরী হয় না। যাদের শরীরে শুক্রানু তৈরী হয় না তারা ধর্ষণ কিভাবে করে সেটিও প্রশ্ন।
এ বিষয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডাঃ অসীম কুমার সাহা বলেন, দশ বা এগারো বছরের শিশু কখনোই ধর্ষণ করতে পারেন বলে আমার অভিজ্ঞতায় এবং চিকিৎসা শাস্ত্র পড়তে গিয়ে পাইনি। ওই শিশুর শারীরীক প্রস্তুতি ১০-১১ বছর বয়সে হয় না। আপনি যা বললেন, আমি জানি না আসলে ঘটনা কি? কিন্তু ধর্ষণের সংজ্ঞা যদি নতুন করে লেখা হয় তাহলে সম্ভব। নতুবা যৌনাঙ্গ র্স্পশ করলেই যদি ধর্ষণ হয় তাহলেও সম্ভব। কিন্তু ‘ইন্টারকোর্স’ বলতে যে বিষয় রয়েছে সেটাইতো মানবদেহে এই বয়সে সঞ্চারিত হয় না। অকল্পনীয়, অসম্ভব ব্যপার হচ্ছে শিশুরা ধর্ষণ করতে পারে বলে। খোঁজ নিয়ে দেখেন, এটা অন্য কিছু।
বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি কাজল ঘোষ মনে করেন, একটি অসম্ভব ঘটনা হচ্ছে ১০-১১ বছরের শিশুরা ধর্ষণ করেছে। আমি মনে করি পরিণত ধর্ষকদের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন চলছে তখন কেউ কেউ ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার করতে এসব অভিযোগ করছেন। আসলে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কখনো দেখিনি বা শুনিনি এই অপরিপক্ব ধর্ষণের কথা। যদি কখনো অভিযোগ উঠেছে তা মিথ্যা প্রমানিত হয়েছে। এটিও তেমন।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বরিশাল জেলার সদস্য সচিব ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী বলেন, আমি সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই বাকেরগঞ্জের এই ধর্ষণ মামলাটি আসলে কতটুকু সত্য তা নিয়ে আমার কাছেই সংশয় রয়েছে। মূলত পারিবারিক বিরোধে প্রতিশোধ নিতে অনেকে আজকাল এমন অভিযোগ করে থাকেন। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে অতটুকুন একটি বাচ্চা কখনো ধর্ষণ করতে পারেন না।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন বরিশাল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কাজী আল-মামুন বলেন, ১০-১১ বছরের শিশুরা ধর্ষণের জন্য পরিণত হয় না চিকিৎসা বিজ্ঞানের এমন কথা আমারও সত্য বলে মনে হয়। যেহেতু দেশে ধর্ষণ বিরোধী একটি অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে তখন কেউ হয়তো সেটিকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এজন্য আমি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ রাখবো অভিযোগ পেলে অবশ্যই তা খতিয়ে দেখে এ্যাকশনে যাওয়া উচিত। অন্যথায় পক্ষ-বিপক্ষের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।