31 C
Dhaka
মে ১, ২০২৫
Bangla Online News Banglarmukh24.com
ইসলাম ধর্ম

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রম ও শ্রমিক

পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত শ্রেণি হলো শ্রমিক শ্রেণি। মহানবী সা:-এর আগমন-পূর্ব যুগের সভ্য সমাজগুলোতে শ্রমিক যেমন মালিক শ্রেণীর হাতে নির্যাতিত হতো, আজও তেমনি তারা চরমভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিপতিদের হাতে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে শ্রমজীবীদের সব সমস্যার সঠিক ও ন্যায়ানুগ সমাধান দিয়েছে। মহানবী সা: এমন একটি সমাজব্যবস্থা কায়েমের ধারণা দিয়েছেন, যেখানে থাকবে না জুলুম-শোষণ, থাকবে না দুর্বলকে নিষ্পেষিত করার মতো ঘৃণ্য প্রবণতা। মহানবী শিখিয়েছেন শ্রমিকও মানুষ, এদেরও বাঁচার অধিকার আছে। এরা তোমাদের ভাই। মালিক পক্ষের উচিত মহান আল্লাহ তাদের প্রতি যেভাবে অনুগ্রহ করেছেন, তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ শ্রমিকদের যথার্থ পাওনা পরিশোধ করা। মহানবী হযরত মুহাম্মদা (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান! মজুরের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি মিটিয়ে দাও।’ (তিরমিজি)।

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রম ও শ্রমিক

শ্রম ও শ্রমিক পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শ্রম হলো, শারীরিক ও মানসিক কসরতের মাধ্যমে কোনও কাজ আঞ্জাম দেয়া। যিনি কাজটি আঞ্জাম দেন তিনি শ্রমিক এবং যে কাজটি সম্পন্ন করা হয় তা উৎপাদন। পুঁজি, শ্রম ও এদের সংগঠনের মাধ্যমে মালিক যা আহরণ করে তা হলো উৎপন্ন দ্রব্য। সাধারণত পুঁজিহীন মানুষ, যারা তাদের পুঁজি বিনিয়োগের উপায় না থাকায় নিজেদের গতর খেটে পেট চালান, তাদের শ্রমিক ও তাদের কাজকে শ্রম বলা হয়। শ্রমিক পুঁজিহীন, দরিদ্র শ্রেণীর লোক বলে তাদের মধ্যে কোনোরূপ লজ্জাকর অনুভূতি ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল কাজে ও হালাল পথে শ্রম বিনিয়োগ কিছুমাত্রও লজ্জার ব্যাপার নয়; বরং এ হচ্ছে নবী-রাসূলগণের সুন্নত। প্রত্যেক নবী-রাসূলই দৈহিক পরিশ্রম করে উপার্জন করেছেন বলে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে।

উপার্জনের প্রতি উৎসাহিত করতে গিয়ে স্বয়ং মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমাদের সালাত শেষ হয়ে যাবে, তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজক) অন্বেষণে ব্যাপৃত হয়ে যাও।’ (সূরা জুমা : ১০)।

ইসলাম সৎ উপার্জনের দিকে যেমন উৎসাহিত করেছে, তেমনি উৎসাহিত করেছে শ্রমের প্রতি। পক্ষান্তরে শ্রম না দিয়ে অলস ও বেকার বসে থাকা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেছেন, ‘কাউকে বেকার বসে থাকতে দেখলে আমার অসহ্য লাগে। জাগতিক কোনও কাজও করে না, অপর দিকে পরকালের নাজাতের জন্যও কোনও প্রয়াস চালায় না।’

এখানে এটা প্রণিধানযোগ্য যে, আধুনিক অর্থনৈতিক মতাদর্শ শ্রমকে কেবল মানুষের পার্থিব জীবন ও তার উপায়-উপকরণের তুলাদণ্ডে বিচার করেছে। তারা শ্রম দ্বারা মানুষের সেই মেধাগত ও শারীরিক অনুসন্ধানকেই কেবল উদ্দেশ্য করেছে, যার বিনিময়ে সে শুধু পয়সাই পায়। কিন্তু মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অর্থনৈতিক মতাদর্শের আলোকে শ্রম হলো, পার্থিব জীবনে মেহনত করে পরকালীন জীবনকেও এর দ্বারা নির্মাণ করা। সুতরাং একজন মুসলমান শারীরিক বা মেধাগত যেকোনো বৃত্তেই শ্রম ব্যয় করুক, সে এর প্রতিদান দুনিয়াতে পয়সার বিনিময়ে এবং আখেরাতে সওয়াব ও জান্নাতের বিনিময়ে পাবে। তাই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শের আলোকে নির্দেশিত অর্থনীতির ভিত্তিতে শ্রমের সংজ্ঞা এভাবে দেয়া যায়, ‘শ্রম ওই মেধাগত ও শারীরিক কর্মবৃত্তির নাম, যার বিনিময়ে এই পার্থিব জীবনে এমন বস্তুগত প্রতিদান অর্জিত হয়, যার দ্বারা মানুষ তার নিজের, তার নিকটজনের এবং সমাজের অভাবী লোকদের প্রয়োজনাদি পূর্ণ করতে পারে এবং জীবিকা ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত হয় অথবা এর বিনিময়ে পুণ্য অর্জিত হয়, যা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানের জন্যই সফলতা ও স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যম হয়।’

শ্রমিকের গুণাবলি

শ্রমিকের এমন কিছু গুণাবলি থাকা প্রয়োজন, যা শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক অটুট রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ইসলাম মালিকদের ওপর অনেক দায়িত্ব যেমন অর্পণ করেছে, তদ্রুপ শ্রমিকের ওপরও আরোপ করেছে কিছু আবশ্যক ন্যায়নীতি। যেমন-

১. আমানতদারিতা : শ্রমিকের ওপর অর্পিত দায়িত্ব অবশ্যই আমানতদারিতার সাথে সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় তাকে মহান আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘সর্বোত্তম শ্রমিক সেই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী ও আমানতদার (দায়িত্বশীল) হয়।’ (সূরা কাসাস : ২৬)।

২. সংশ্লিষ্ট কাজের দক্ষতা ও যোগ্যতা : দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজের জ্ঞান, যোগ্যতা ও দক্ষতা তার থাকতে হবে। শারীরিক ও জ্ঞানগত উভয় দিক থেকেই তাকে কর্মক্ষম হতে হবে।

৩. কাজে গাফিলতি না করা : ইসলাম কাজে গাফিলতিকে কোনো মতেই সমর্থন করে না। আল্লাহ বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়, যারা লোকের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে, আর যখন তাদের জন্য মেপে অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’ (সূরা মোতাফফিফিন : ১-৩)। আয়াতের অর্থ হলো, নিজে নেয়ার সময় কড়ায়গণ্ডায় আদায় করে নেয়। কিন্তু অন্যকে মেপে দিতে গেলে কম দেয়। ফকিহদের মতে, এখানে তাওফিফ বা মাপে কম-বেশি করার অর্থ হলো, পারিশ্রমিক পুরোপুরি আদায় করে নিয়েও কাজে গাফিলতি করা। অর্থাৎ আয়াতে ওই সব শ্রমিকও শামিল যারা মজুরি নিতে কমতি না করলেও কাজে গাফিলতি করে; কাজে ফাঁকি দিয়ে ওই সময় অন্য কাজে লিপ্ত হয় বা সময়টা অলস কাটিয়ে দেয়। তাদেরকে কঠোর শাস্তির হুমকি দেয়া হয়েছে।

৪. নিজের কাজ হিসেবে করা : কাজে নিয়োগ পাওয়ার পর শ্রমিক কাজকে নিজের মনে করে সম্পন্ন করবে। অর্থাৎ পূর্ণ দায়িত্বশীলতার সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজটি সম্পাদন করে দেয়া তার দায়িত্ব হয়ে যায়।

৫. আখেরাতের সফলতার জন্য কাজ করা : একজন শ্রমিক তার শ্রমের মাধ্যমে যে অর্থ উপার্জন করবে, তা যেন হালাল হয় এবং এর বিনিময়ে পরকালীন সফলতা লাভে ধন্য হয় তার প্রতি লক্ষ রাখবে। সেবার মানসিকতা নিয়ে পরম আগ্রহ ও আনন্দের সাথে কাজটি সম্পন্ন করাই হবে শ্রমিকের নৈতিক দায়িত্ব।

শ্রমিকদের মর্যাদা

ইসলাম শ্রমিকদের যে মর্যাদা দেয় পৃথিবীর যেকোনও ইতিহাসের যেকোনও অধ্যায়ের সমাজব্যবস্থায় তা নজিরবিহীন। মহানবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘অধীনস্থদের সাথে অসদাচরণকারী বেহেশতে যেতে পারবে না।’ (তিরমিজি)।

মহানবী (সা.) শ্রমজীবীদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘আপন সন্তানসন্ততির মতো তাদের মানসম্মানের সাথে তত্ত্বাবধান করো আর তাদের খেতে দেবে, যা তোমরা নিজেরা খেয়ে থাকো।’ (মিশকাত, ইবনে মাজাহ)।

কেউ যদি শ্রমিকের মজুরি না দেয় অথবা দিতে গড়িমসি করে, তার বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন যে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ থাকবে, তাদের একজন হলো, এমন লোক যে কাউকে শ্রমিক নিয়োগ করে কাজ পুরোপুরি আদায় করে নিলো অথচ মজুরি দিলো না।’ (বুখারি শরিফ)।
মজুরি না দেয়ার অর্থ কেবল মজুরি না দিয়ে তা মেরে খাওয়া নয়; বরং যে পরিমাণ মজুরি প্রাপ্য, তা ষোলোআনায় না দেয়া আর তার সরলতার সুযোগে কাজ করিয়ে নিয়ে সামান্য মজুরি দেয়া।

উপসংহার

বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) শ্রমজীবী মানুষ ও খেটে খাওয়া অসহায় ক্ষুধার্থ শ্রেণীর প্রতি কেমন সযত্ন দৃষ্টি রাখতেন, তাঁর ভালোবাসার আধার হৃদয়জুড়ে এই দুর্বল সহায়হীন শ্রেণীর স্থান কতটুকু ছিল, কতটুকু মমতা তিনি তাদের জন্য লালন করতেন উপরিউক্ত আলোচনা থেকে তা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করা যায়। জাহেলি যুগের অমানবিক শ্রমিক নির্যাতন ও বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে তাকে মালিক শ্রেণীর সমকক্ষ মর্যাদা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছেন মহানবী সা:। তিনি মালিক ও শ্রমিককে পরস্পর ভাই ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি যখন এই পার্থিব জীবনের সব সম্পর্ক ঘুচিয়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে যাত্রা করেছিলেন, সেই অন্তিম মুহূর্তে তার পবিত্র মুখে যে শেষ শব্দটি ধ্বনিত হয়েছিল, সেটাও ছিল এই শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি তাঁর সযত্ন দৃষ্টি ও সহমর্মিতার সৌহার্দ্যপূর্ণ আশ্বাস। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘তোমরা সব সময় তোমাদের নামাজ ও তোমাদের অধীনস্থদের প্রতি সহমর্মিতা ও দায়িত্বপূর্ণ দৃষ্টি রাখবে।’ (আল আদাবুল মুফরাদ)।

সম্পর্কিত পোস্ট

রোজা রেখে আতর-পারফিউম ব্যবহার করা যাবে?

banglarmukh official

গর্ভবতী নারীর রোজার মাসয়ালা

banglarmukh official

তারাবির নামাজ ছুটে গেলে করণীয়

banglarmukh official

রোজা অবস্থায় কি দাঁত ব্রাশ করা যাবে?

banglarmukh official

চাঁদ দেখা গেছে, সৌদি আরবে রোজা শুরু শনিবার

banglarmukh official

শাবান মাসে কত তারিখ পর্যন্ত রোজা রাখা যাবে

banglarmukh official